বিগত এক দশকের অধিক কালব্যাপী আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা বৃদ্ধিপাত করিয়া রাখার হীন উদ্দেশ্যে অনেক অযৌক্তিক মৌলিক সাংবিধানিক সংশোধনী আনয়ন করিয়াছে। একটি “সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করিয়া সকল বিতর্কিত ও অতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনসমূহ পর্যালোচনা করিয়া এইসব রহিত/ সংশোধন করা হইবে এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় সাংবিধানিক সংস্কার করা হইবে। সংবিধানে গণভোট (referendum ) ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করিয়া জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হইবে।
রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা!
(সংবিধান ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার, অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে প্রণীত )
বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়া এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র গড়িয়া তুলিয়াছিল, সেই রাষ্ট্রের মালিকানা আজ তাহাদের হাতে নাই। বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকার বাংলাদেশ রাষ্ট্র কাঠামোকে ভাঙ্গিয়া চুরমার করিয়া ফেলিয়াছে। এই রাষ্ট্রকে মেরামত ও পুনগঠন করিতে হইবে। দেশের জনগণের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরাইয়া দেওয়ার লক্ষ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জয়লাভের পর বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকার হঠানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলসমূহের সমন্বয়ে একটি "জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার" প্রতিষ্ঠা করা হইবে।
উক্ত “জাতীয় সরকার” নিম্নলিখিত রাষ্ট্র রূপান্তরমূলক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করিবে।
প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সকল মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক। “Rainbow Nation" প্রতিষ্ঠা করা হইবে। এই জন্য অব্যাহত আলোচনা, মতবিনিময় ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎমুখী এক নতুন ধারার সামাজিক চুক্তিতে (Social Contract) পৌঁছাইতে হইবে। এই জন্য একটি "National Reconciliation Commission" গঠন করা হইবে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এবং সঙ্গ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে স্থায়ী সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে একটি “নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার" ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হইবে।
সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনয়ন করা হইবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য ( Checks and Balances) প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাহী বিভাগ,আইন বিভাগ ও বিচারবিভাগের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের সুসমন্বয় করা হইবে।
পরপর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করিতে পারিবেন না।
বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদে “উচ্চ কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা ( Upper House of the Legislature) প্রবর্তন করা হইবে।
আস্থাভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী বিল এবং বতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত এমন সব বিষয় ব্যতীত অন্যসব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রদানের সুযোগ নিশ্চিত করিবার লক্ষ্যে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়া (দেখা হইবে) বিবেচনা করা হইবে।
রাজনৈতিক দলসমূহের মতামত এবং বিশিষ্টজনের অভিমতের ভিত্তিতে স্বাধীন, দক্ষ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও দৃঢ়চিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন করিবার লক্ষ্যে বর্তমান "প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২ সংশোধন করা হইবে। ইভিএম নয়, সকল কেন্দ্রে পেপার-ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদান নিশ্চিত করা হইবে। RPO, Delimitation Order এবং রাজনৈতিক নিবন্ধন আইন সংস্কার করা হইবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করা হইবে।
সংকীর্ণ রাজনৈতিক দলীয়করণের ঊর্ধ্বে উঠিয়া সকল রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক ও সংবিধিবন্ধ প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করিবার লক্ষ্যে এই সকল প্রতিষ্ঠান আইনি সংস্কারের মাধ্যমে পুনঃগঠন করা হইবে। নোনির মাধ্যমে সংসদীয় কমিটির ভেটিং সাপেক্ষে এই সকল প্রতিষ্ঠানের সাংবিধানিক ও গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে নিয়োগ প্রদান করা হবে
বাংলাদেশের সংবিধান ও মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হইবে। বর্তমান বিচারব্যবস্থার সংস্কারের জন্য একটি “জুডিশিয়াল কমিশন গঠন করা হইবে। অহন আদালতসমূহের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানের কর্তৃত্ব সুপ্রিম কোর্টের নিকট ন্যাস্ত হইবে (সংবিধানের ভাষা)। বিচার বিভাগের জন্য সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি পৃথক সচিবালয় থাকিবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসন প্রশ্নে সংবিধানে বর্ণিত ইতোপূর্বেকার “সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল" ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হইবে। এইজন্য সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনয়ন করা হইবে। দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠিয়া কেবলমাত্র জ্ঞান, প্রজ্ঞা, নীতিবোধ, বিচারবোধ ও সুনামের কঠোর মানদণ্ডে যাচাই করিয়া বিচারক নিয়োগ করা হইবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের লক্ষ্যে সংবিধানের ৯৫(গ) অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও মানদণ্ড সম্বলিত "বিচারপতি নিয়োগ আইন” প্রণয়ন করা হইবে।
দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ পরিবেশ, জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন গড়িয়া তোলার লক্ষ্যে যোগ্য, অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ ব্যাক্তিদের সমন্বয়ে একটি প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন" গঠন করিয়া প্রশাসন সংস্কার ও পুনঃগঠন করা হইবে। মেধা, সততা, সৃজনশীলতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসনে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি হিসাবে বিবেচনা করা হইবে।
গণমাধ্যমের পুর্নস্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান ও সার্বিক সংস্কারের লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি, মিডিয়া সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী এবং বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ ও গ্রহণযোগ্য মিডিয়া ব্যক্তিদের সমন্বয়ে লক্ষ্যে একটি “মিডিয়া কমিশন" গঠন করা হইবে। সৎ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ পুনরুদ্ধার করিবার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হইবে, এই লক্ষ্য ICT Act 2006. সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯ এর প্রয়োজনীয় সংশোধন ও Special Power Act-1974, Digital Security Act- 2018 সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সকল কালাকানুন বাতিল করা হইবে। চাপল্যকর সাগর-রুনি হত্যাসহ সকল সাংবাদিক নির্যাতন ও হত্যার বিচার নিশ্চিত করা হইবে।
দুর্নীতির ক্ষেত্রে কোন আপোষ করা হইবে না। বিগত দেড় দশকব্যাপী সংগঠিত অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করিয়া একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা এবং শ্বেতপত্রে চিহ্নিত দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে। দেশের বাহিরে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে। দুর্নীতি দমন কমিশন ও দুর্নীতি দমন আইন সংস্কারের পাশাপাশি পদ্ধতিগত সংস্কারের মাধ্যমে দুদকের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হইবে। সংবিধান অনুযায়ী “ন্যায়পাল (Ombudsman)" নিয়োগ করা হইবে।
সর্বস্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হইবে। মানবিক মূল্যবোধ ও মানুষের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং অমানবিক নিষ্ঠুর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অবসান ঘটানো হইবে। Universal Declaration of Human Rights অনুযায়ী মানবাধিকার বাস্তবায়ন করা হইবে। সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে মানবাধিকার
কমিশনে নিয়োগ প্রদান করা হইবে। গত দেড় দশক যাবত সংগঠিত সকল বিচারবহির্ভূত হত্যা, ক্রসফায়ারের নামে নির্বিচারে হত্যা, গুম, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, নির্মম শারীরিক নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর ও অমানবিক অপরাধের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সকল ব্যক্তিকে প্রচলিত আইন অনুযায়ী সুবিচার নিশ্চিত করা হইবে।
অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করিবার লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ও গবেষক, অভিজ্ঞ ব্যাংকার, কর্পোরেট নেতা, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি সমন্বয়ে একটি "অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠন করা হইবে। মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের নিরিখে প্রবৃদ্ধির সুফল সুষম বণ্টনের মাধ্যমে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূরীকরণ করা হইবে। উপরোক্ত সাংবিধানিক সংস্কার কমিশন, প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন, জুডিশিয়াল কমিশন, মিডিয়া কমিশন এবং অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশনগুলি সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে স্ব-স্ব প্রতিবেদন দাখিল করিবে যেন সংশ্লিষ্ট সুপারিসসমূহ দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়।
ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার" এই মূলনীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার ভোগ করিবেন। দলমত ও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পাহাড়ি ও সমতলের - জাতি-গোষ্ঠীর সংবিধান প্রদত্ত সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্ম-কর্মের অধিকার, নাগরিক অধিকার এবং জীবন, সপ্তম ও সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা হইবে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ঘর-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয় ভাঙচুর এবং তাদের সম্পত্তি দখলের জন্য নায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।
মুদ্রাস্ফীতির আলোকে শ্রমিকদের Price-index based ন্যায্য মঞ্জুরি নিশ্চিত করা হইবে। শিশু-শ্রম বন্ধ করে তাদের জীবন বিকাশের উপযোগী পরিবেশ ও ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হইবে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও গণতান্ত্রিক ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করা হইবে। পাটকল, বস্ত্রকল, চিনিকলসহ সকল বন্ধ শিল্প পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেওয়া হইবে। প্রবাসী শ্রমিকদের জীবন, মর্যাদা ও কর্মের নিরাপত্তা এবং দেশে বিমানবন্দরসহ সকল ক্ষেত্রে হয়নি মুক্ত সেবা প্রাপ্তি ও ভোটাধিকার নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা হইবে। চা-বাগান, বাঙ্গি, চরাঞ্চল, হাওর-বাওর ও মঙ্গাপীড়িত ও উপকূলীয় অঞ্চলের বৈষম্য দূরীকরণ ও সুষম উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচী গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হইবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে দায়মুক্তি আইনসহ সকল কালাকানুন বাতিল করা হইবে এবং রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ রোধ করিবার লক্ষ্যে জনস্বার্থবিরোধী কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো হইতে বিদ্যুৎ ক্রয়ে চলমান সীমাহীন দুর্নীতি বন্ধ করা হইবে। আমদানি নির্ভরতা পরিহার করিয়া নবায়নযোগ্য ও মিশ্র এনার্জি-নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং উৎপক্ষিত গ্যাস ও খনিজ সম্পদ আবিষ্কার ও আহরণে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে। শিল্পখাতের বিকাশে বিনিয়োগ বান্ধব নীতি গ্রহণ করিয়া দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা হইবে। প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিনিয়োগে উৎসাহ, সুযোগ ও প্রনোদনা দেওয়া হইবে। পরিকল্পিতভাবে দেশব্যাপী সমন্বিত শিল্প অবকাঠামো পড়িয়া তোলা হইবে।
বৈদেশিক সম্পর্কের সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হইবে। সমতা, ন্যায্যতা, পারস্পরিক স্বার্থের স্বীকৃতি ও স্বীকৃত আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান অনুযায়ী দ্বি-পাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সমস্যাদির সমাধান করা হইবে। বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডের মধ্যে কোনো প্রকার সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাশত করা হইবে না এবং কোন সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা আশ্রয় প্রশ্ন পাইবে না। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও উৎবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদকে রাজনৈতিক চাল বা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করিয়া এবং সন্ত্রাসবাদের তকমা লাগাইয়া ভিন্নমতের বিরোধী শক্তি এবং রাজনৈতিক বিরোধীদল দমনের অপতৎপরতা বন্ধ করা হইলে প্রকৃত সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করা এবং আইনের আওতায় আনিয়া শাস্তি প্রদান করা সম্ভব হইবে।
দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সুসংগঠিত, যুগোপযোগী এবং সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের মধে উজ্জীবিত করিয়া পড়িয়া তোলা হইবে। স্বকীয় মর্যাদা বহাল রাখিয়া প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সকল বিতর্কের উর্ধ্বে রাখা হইবে।
ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলিকে অধিকতর স্বাধীন, শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান করা হইবে। এই সকল প্রতিষ্ঠানকে এমনভাবে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হইবে যেন তাহারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন পরিষেবা প্রদান ও উন্নয়ন কার্যক্রমে কার্যকর ভূমিকা রাখিতে পারে। স্থানীয় প্রশাসন ও অন্য কোনো জনপ্রতিনিধির বরদারী মুক্ত স্বাধীন স্থানীয় সরকার নিশ্চিত করা হইবে। মৃত্যুজনিত কারণ কিংবা আদালতের আদেশে পানশূন্য না হইলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে সরকারি প্রশাসক নিয়োগ করা হইবে না। আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নির্বাহী আদেশবলে সাসপেন্ড বরখাস্ত/অপসারণ করা হইবে না।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে যার যার অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা করা হইবে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিবিড় জরিপের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হইবে এবং তাঁহাদের যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদান করা হইবে। এই তালিকার ভিত্তিতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কল্যাণার্থে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হইবে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করিয়া একটি সঠিক তালিকা প্রস্তুত করা হইবে।
যুবসমাজের ভিশন, চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করিয়া আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব-উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হইবে। এক বছরব্যাপী অথবা কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত, যেটাই আগে হইবে, শিক্ষিত বেকারদের বেকার ভাতা প্রদান করা হইবে। বেকারত্ব দূরীকরণের লক্ষ্যে নানামুখী বাস্তবসম্মত কর্মসূচী গ্রহণ করা হইবে। যুব সমাজের দক্ষতা (Skill Development) বৃদ্ধি করিয়া "ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড" আদায়ের লক্ষ্যে দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহন করা হইবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পুষ্টির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়া মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করা হইবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সরকারি চাকুরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি বিবেচনা করা হইবে।
জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করিবার লক্ষ্যে নারীর ক্ষমতায়নে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী গ্রহণ করা হইবে। নারী ও শিশুদের জীবন মান বিকাশের নিমিত্তে যুগোপযোগী উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হইবে। জাতীয় সংসদে মনোনয়নের ক্ষেত্রে নীতিগতভাবে নারীদের প্রাধান্য দেওয়া হইবে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হইবে।
বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান নৈরাজ্য দূর করিয়া নিম্ন ও মধ্য পর্যায়ে চাহিদা ভিত্তিক শিক্ষা (Need based education) এবং উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে (Knowledge-based education) প্রাধান্য দেওয়া হইবে। গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হইবে। একই মানের শিক্ষা ও মাতৃভাষায় শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হইবে। ভবিষ্যতের নেতৃত্ব গড়ে তুলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ছাত্র সংসদে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হইবে। যোগ্য, দক্ষ ও মানবিক জনগোষ্ঠী গড়িয়া তোলার লক্ষ্যে জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫% অর্থ বরাদ্দ করা হইবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে ক্রমান্বয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হবে। দক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষা প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণসহ সংশ্লিষ্ট সকল খাতকে ঢালিয়া সাজানো হইবে। শিক্ষা, শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং উৎপাদানখাতে গবেষণা ও উন্নয়নকে ( R&D) সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হইবে। ক্রীড়া উন্নয়ন ও জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে। অনৈতিক আকাশ সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রোধ করা হইবে।
স্বাস্থ্যকে সম্পদ হিসাবে বিবেচনা করিয়া "সবার জন্য স্বাস্থ্য" ও "বিনা চিকিৎসায় কোন মৃত্যু নয়” এই নীতির ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের NHS এর আদলে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা (Universal health coverage) প্রবর্তন করিয়া সবার জন্য স্বাস্থ্য কার্ড চালু করা হইবে। জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৫% অর্থ বরাদ্দ করা হইবে। দারিদ্র্য বিমোচন না হওয়া পর্যন্ত সুবিধা বঞ্চিত হত দরিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আরো সম্প্রসারিত করা হইবে।
কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হইবে। পর্যায়ক্রমে সকল ইউনিয়নে কৃষিপণ্যের জন্য সরকারি ক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হইবে। প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়া হইলেও শস্য বীমা, পশু বীমা, মংসা বীমা এবং পোল্ট্রি বীমা চালু করা হইবে। কৃষি জমির অকৃষি ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হইবে। কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়ন এবং গবেষণার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্ম-কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হইবে । এতদসংশ্লিষ্ট রফতানিমুখী কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প খাতকে প্রণোদনা দেওয়া হইবে।
দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে সড়ক, রেল ও নৌপথের প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সারা দেশে সমর্থিত বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়িয়া তোলা হইবে। দেশের সমুদ্র বন্দর ও নৌবন্দর সমূহের আধুনিকায়ন, উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হইবে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট ও ক্ষতি মোকাবিলায় টেকসই ও কার্যকর কর্মকৌশল গ্রহণ করা হইবে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও ভুমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সর্বাধুনিক ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হইবে। নদী ও জলাশয় দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হইবে এবং বন্যা ও খরা প্রতিরোধে খাল-নদী খনন পুনঃখনন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হইবে। সামুদ্রিক সম্পদের বিজ্ঞান সম্মত জরিপ ও মজুদের ভিত্তিতে তা আহরণ এবং অর্থনৈতিক ব্যবহারের ব্যবস্থা নেওয়া হইবে।
তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তিখাতকে বৈশ্বিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সর্বক্ষেত্রে এর প্রয়োগকে প্রাধান্য দেওয়া হইবে। মহাকাশ গবেষণা এবং আনবিক শক্তি কমিশনের কার্যক্রমের প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রায়োগিক সুযোগ সমৃদ্ধ করা হইবে।
এক জাতীয় মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে শহরে ও গ্রামে কৃষি জমি নষ্ট না করিয়া এবং নগরে জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ হ্রাস করিয়া পরিকল্পিত আবাসন ও নগরায়নের নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হইবে। পর্যায়ক্রমে দেশের সকল দরিদ্র জনগোষ্ঠির আবাসন নিশ্চিত করা হইবে।
(রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের এই রুপরেখা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ঘোষিত ১৯ দফা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ঘোষিত বিএনপির ভিশন-২০৩০' এর আলোকে এবং দেশনায়ক তারেক রহমানের ঘোষিত ২৭ দফা কর্মসূচির সংশোধীত ও সম্প্রসারিত রূপে প্রণীত।)