১২ মে ২০২৪
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র
জাতীয় স্থায়ীকমিটির ভার্চুয়াল সভার সিদ্ধান্ত সমূহ
গত ৮ মে ২০২৪ তারিখ, বুধবার, রাত ৮.০০ টায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র জাতীয় স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান।
সভায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য যথাক্রমে
১. মির্জা আব্বাস
২. বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়
৩. ড. আব্দুল মঈন খান
৪. জনাব নজরুল ইসলাম খান
৫. মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
৬. জনাব আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী
৭. জনাব সালাহ উদ্দিন আহমেদ
৮. বেগম সেলিমা রহমান
৯. জনাব ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু
সভায় আলোচ্য বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা শেষে নিন্মে বর্ণিত সিদ্ধান্ত সমূহ গৃহীত হয়।
১। সভায়, গত ২২ এপ্রিল ২০২৪ অনুষ্ঠিত জাতীয় স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কে মহাসচিব জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভাকে অবহিত করেন।
২। সভায়, সভায় নির্বাচনকালীন সময়ে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবীতে আন্দোলনরত বিরোধী নেতা-কর্মীদের পূর্বে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলায় একতরফা শুনানী করে অফিযুক্ত নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করার প্রক্রিয়া কে তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। সভা মনে করে অবৈধ সরকারের সাজানো নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার লক্ষে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সাজা দিয়ে কারান্তরীন করে বিরাজনীতি করনের প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়িত করার জন্য বিচার প্রক্রিয়াকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। সম্পূর্ন বানোয়াট মিথ্যা গায়েবী মামলায় প্রায় ২ হাজার নেতা-কর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। চলমান প্রক্রিয়া হিসাবে সাজা প্রদান করা হচ্ছে। সাভা অবিলম্বে এ প্রক্রিয়া বন্ধ করে সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং বিচার প্রক্রিয়াকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়।
৩। সভায়, গভীর উদ্বেগের সঙ্গে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। সভা মনে করে, দেশে যে ভয়াবহ সর্বগ্রাসী দূর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে সরকারী দলের সমর্থক সঙ্গে সম্পৃক্ত ঋণ খেলাপী ও অসাধু ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। যেহেতু এই সরকারের কোনও স্তরেই কোনও জবাবদিহিতা নেই সেইহেতু লাগামহীন ভাবে ব্যাংক লুঠ, অর্থ পাচার, জনগণের অর্থ লোপাটের মাধ্যমে একটি বিশেষ গোত্র তৈরী করা হচ্ছে। যারা এই অবৈধ সরকারের অবৈধ কর্মকান্ডকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে। সভায় অবৈধ তথ্য-প্রবাহে বাধা দানের প্রচেষ্টার তীব্র নিন্দা প্রকাশ করা হয় এবং অবিলম্বে অবৈধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিতের লক্ষে সকল প্রকার অসাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা আইন প্রত্যাহারের দাবী জানানো হয়।
৪। সভায় সম্প্রতি দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। তাতে বলা হয় বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর প্রায় ৭০ শতাংশই ঘটে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক কিংবা ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন ধরনের অসংক্রামক রোগে। অথচ এসব রোগ মোকাবেলায় সরকারের অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ মাত্র মোট স্বাস্থ্য বাজেটের ৪ দশমিক ২ শতাংশ। এর আগে গত মার্চ মাসে সিপিডির একটি রিপোর্টেও জনস্বাস্থ্যের এক ভয়ঙ্কর চিত্র ফুটে উঠেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশের প্রায় ১৩ কোটি মানুষ প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে পারছেন না। গত মার্চ মাসেই বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ / বিএফএসএ’র শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন দেশে প্রতিবছর ১ লাখ ১৪ হাজার মানুষ ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করছে। এই ক্যন্সারের মূল কারণ অনিরাপদ খাদ্য।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় অবৈধ সরকার কি ধরণের ব্যবস্থা নিয়েছে। জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তায় এই সরকার কেন এতো উদাসীন। জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষে দেশের নাগরিকদেরকে পুষ্টিকর খাদ্য যোগান দেয়া, অনিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে সচেতন করা সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
সভা মনে করে, নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্র্রসংঘ কি ধরণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বা রাখা উচিত, সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ছাড়াও আরো কয়েকটি দেশ এমন একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংস্থা র্যাপিড অ্যালার্ট সিস্টেম ফর ফুড অ্যান্ড ফিড / আর-এস-এফ-এফ (জধঢ়ঢ়রফ অষবৎঃ ঝুংঃবস ভড়ৎ ভড়ড়ফ ধহফ ভববফ-জধংভভ), গত এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলেছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রপ্তানি করা ৫২৭টি ভারতীয় পণ্যে ক্যান্সার উপযোগী উপাদান পেয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত এই সময়ের মধ্যে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর আরএএসএফএফ জানিয়েছে, ৫২৭টি পণ্যের মধ্যে ৩৩২টি খাবার পণ্যের উৎস ভারতে। বাকি পণ্যগুলো সরাসরি ভারতের না হলেও সেগুলোতে ভারতের ট্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে। এসব ভোগ্য পণ্যের মধ্যে রয়েছে, বাদাম, তিল বীজ, ভেষজ, মশলা, ডায়েবেটিক জাতীয় খাবার। এ সকল পণ্যের মধ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান ইতিলিন অক্সাইড শনাক্ত করা হয়েছে। এই রাসায়নিক উপাদান মানব দেহে প্রবেশ করলে ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি লিম্ফোমা এবং লিুকেমিয়ার ঝুঁকিও রয়েছে। এই রিপোর্ট প্রকাশের পর ভারতের ৮৭টি পণ্যের চালান ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ঢুকতে দেয়া হয়নি।
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স, ভারতের ডেকান হেরাল্ড, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসসসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ এই তথ্যটি প্রকাশিত হয়েছে।
সভায় বলা হয়, ৫২৭টি পণ্য সম্পর্কে খোদ ভারতীয় প্রতিষ্ঠান রামাইয়া অ্যাডভান্সড টেস্টিং ল্যাবের চিফ অপারেটিং অফিসার জুবিন জর্জ জোসেফ বলেছেন, এসব পণ্যে ইথিলিন অক্সাইড ছাড়াও আরও ২টি রাসায়নিক বিষাক্ত উপাদান পাওয়া গিয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপদজ্জনক হল ইতিলিনগ্লাইকোল। যেটি মূলত কাশির সিরাপে ব্যবহার করা হয়। এর ফলে শিশুদের মৃত্যুও পর্যন্ত হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে জুবিন জর্জ জোসেফ পরামর্শ দিয়ে বলছেন, প্রতিটি দেশেরই উচিত, নিজ নিজ দেশে আমদানি পণ্য পৌঁচার পর পণ্যের নিরাপত্তা মান পরীক্ষা করা। আমদানি করা পণ্য পৌঁছো সংশ্লিষ্ট দেশে পৌঁছা মাত্রই জনগণের ক্রয়ের জন্যে বাজারে পাঠিয়ে দেয়া উচিত নয়। কারণ, এর আগেও ২০২২ এবং ২০২৩ সালে ১২১টি ভারতীয় পণ্য মানব দেহের জন্য ক্ষতিকারক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল কিন্তু তারপরেও পণ্যের উৎস দেশটি এই পণ্যগুলো ত্রুটিমুক্ত করার জন্য জন্য কোনও উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
ইতোমধ্যেই অনেকেই জানেন কিম্বা দেখেছেন, গত ২৩ এপ্রিল ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, হংকং এবং সিঙ্গাপুর তাদের দেশে ভারতীয় কোম্পানি এমডিএইচ ও এভারেস্ট স্পাইসেরে গুাঁড়া মসলা বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এমনকি দেশটিতে পরীক্ষার আগেই ঢুকে পড়া মাছ রান্নায় ব্যবহৃত এমডিএইচের তিন ধরনের গুাঁড়া মশলা ও এভারেস্টের একটি গুাঁড়া মশলার বিক্রি স্থগিত করেছে। সিঙ্গাপুরও দেশটির বাজার থেকে এভারেস্টের গুাঁড়া মশলা প্রত্যাহার করার নির্দেশ দিয়েছে। হংকং ভারতীয় দুই কোম্পানির গুাঁড়া মশলায় ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক ইথিলিন অক্সাইড শনাক্ত হওয়ার পর দেশ দুইটি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে সভা মনে করে, জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশেরও উচিত দেশে আমদানি করা প্রতিটি পণ্য বাজারে ছাড়ার আগে যথাযথভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা পণ্যের মান যাচাই করে নেয়া। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ / বিএফএসএ কিংবা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য বাজারে ছাড়া উচিত নয়। তবে দেশের নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বর্তমান তাবেদার সরকার আমদানি করা খাদ্যপণ্য যথাযথভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করবে কিনা এ ব্যাপারে জনগণ যথেষ্ট সন্দিহান।
সুতরাং, আমদানি করা পণ্য যথাযথভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যাপারে নিশ্চিত না হওয়া গেলে প্রতিটি নাগরিককে নিজের এবং নিজেদের পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থা রক্ষায় নিজ উদ্যোগেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। স্বাস্থ্য নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমদানি করে বাজারে ছেড়ে দেয়া ক্যান্সারের উপদানযুক্ত সকল পণ্য পরিহার করতে হবে। জলবায়ু তহবিলের টাকা লোপাটকারী তাবেদার সরকারের উপর ভরসা না করে নিজেই নিজের সাধ্যমত নিজের এবং পরিবারের স্বাস্থ্য রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। সভা মনে করে, সকলের মনে রাখা প্রয়োজন ৭ই এপ্রিল বিশ^ স্বাস্থ্য দিবসের এবারের স্লোগান ছিল আমার স্বাস্থ্য - আমার অধিকার।
শিক্ষা স্বাস্থ্য, সামাজিক উন্নয়ন সম্পর্কিত বিষয়গুলো সম্পর্কে আরো বেশি সতর্ক না হলে শুধু বর্তমান প্রজন্মই নয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও আরো বিপর্যয়কর পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থা ব্যবস্থার সঙ্গে জনগণের জীবনমান উন্নয়নের বিষয়টিও ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। সড়ক ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণ তথা অবকাঠামোগত উন্নয়ন এগুলো কোনো একটি দেশের যে কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের একটি রুটিন ওয়ার্ক। তবে অগণতান্ত্রিক সরকার এসব তথাকথিত উন্নয়ন হিসেবে প্রচার করে জনগণের অন্য সকল অধিকারকে অবজ্ঞা করে চলছে। কেবলমাত্র আর্থিক কিংবা অবকাঠামোগত ফাঁপা উন্নয়ন রাষ্ট্র বা সমাজের উন্নয়নের মাপকাঠি হতে পারে না। জীবন মান তথা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সামাজিক এবং নৈতিকতার মুল্যবোধের উন্নয়ন ছাড়া কোনো উন্নয়নই টেকসই নয়। সুতরাং, তথাকথিত উন্নয়নের দোহাই দিয়ে যে রাষ্ট্রব্যবস্থায় নৈতিকতা এবং মুল্যবোধকে বিসর্জন দেওয়া হয়, জনগণের কাছে সেটি উন্নত রাষ্ট্র হিসাবে বিবেচিত হয়না। মনে রাখা প্রয়োজন, জীবন এবং জীবিকার দ্ব›েদ্ধ জীবিকার কাছে যেন জীবন হেরে না যায়। তেমন একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সমাজ বিনির্মানের লক্ষেই চলমান আন্দোলন এবং জনগণের এই আকাঙ্খা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত বিএনপি’র আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
৫। সভা শেষে সভাপতি সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে সভা মুলতবী করেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
মহাসচিব
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি