image

তারিখঃ ১৯ আগস্ট, ২০২৩

প্রেস বিজ্ঞপ্তি

বিএনপি’র তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান এর বিবৃতি

সম্প্রতি বর্তমান সরকার নিপীড়নমূলক এবং নিবর্তনমূলক ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’ রহিত করবার নীতিগত ঘোষণা দিয়েছে, এবং আইনটির পরিবর্তে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩’ নামে নতুন আরেকটি আইন প্রস্তাব করেছে। দুঃখজনকভাবে নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করবার নীতিগত ঘোষণাটি বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য স্বস্তিদায়ক এবং আশাব্যাঞ্জক হবার পরিবর্তে অত্যন্ত উদ্বেগ-উৎকন্ঠা এবং অস্বস্তির বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়বস্তুসমূহ, এবং সাইবার নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সমূহের কাঠামো এবং কার্যক্রম প্রায় হুবহু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতই রাখা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বহুল অপব্যবহৃত পুলিশ অফিসার কর্তৃক পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেফতার করার অবাধ ক্ষমতা প্রস্তাবিত আইনে প্রায় একই রকম রাখা হয়েছে। শুধুমাত্র ‘ডিজিটাল’ শব্দের পরিবর্তে ‘সাইবার’ শব্দটি আইনের শিরোনামে যোগ করে এবং কিছু লোক দেখানো পরিবর্তন এনে জনগণকে ধোঁকা দেয়ার ঘৃণ্য কৌশল আওয়ামী লীগ সরকার নিয়েছে। তাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে বিভিন্ন সময় দেশী ও বিদেশী নাগরিক সমাজের অংশীজন, মানবাধিকার সংস্থাসমূহ, এবং বিশেষজ্ঞদের প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদন, প্রস্তাবনা, দাবী ও উদ্বেগগুলোকে প্রস্তাবিত আইনটিতে অনেকাংশে পাশ কাটানো হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপঃ জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দফতর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা বাতিল ও আটটি ধারা (৮, ২৫, ২৭, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) সংশোধনের প্রস্তাব করেছিলো। কিন্তু ধারা ২১ ও ২৮ বাতিল না করে সাজা ও জামিনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়েছে। অন্যদিকে সংশোধনের জন্য ৮টি ধারার (৮, ২৫, ২৭, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) মধ্যে ৬টিতে মূলত সাজা এবং জামিনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে উল্লিখিত জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সি এবং জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কাউন্সিল এর কার্যক্রম, গঠন ও ক্ষমতাবলীও প্রায় হুবহু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে উল্লিখিত ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিলের মতন।

উল্লেখ্য যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ২৮, ২৯ এবং ৩১ ধারা অসাংবিধানিক ঘোষণা করার জন্য ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি নয়জন শিক্ষক, সাংবাদিক ও আইনজীবী হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেছিলেন। এই রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ এবং ৩১ ধারা কেনো অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না এই মর্মে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় ও কর্তাব্যক্তির প্রতি রুল জারি করেন। কিন্তু অদ্যাবধি সরকারের তরফ থেকে সেই রুলে জবাব দেয়া হয়েছে কিনা সে সংক্রান্ত কোন তথ্য দেশের জনগণ জানেন না। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে উল্লিখিত অপরাধসমূহের বিচারকার্য পরিচালিত হবে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬’ এর অধীনে গঠিত সাইবার ট্রাইব্যুনালে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচন নামক প্রহসনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে রাখা আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ এবং দলীয়করণ করা হয়েছে। তাই আজ অন্যান্য অধস্তন ও উচ্চ আদালতগুলোর মতন সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্যও ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। গবেষণা প্রতিবেদন লেখার কারণে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ কে বাতিলকৃত আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় বিচারিক হয়রানী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরার জামিন বারবার নামঞ্জুর, শিশু আইন ২০১৩ এর নীতিমালা অনুসরন না করে সাইবার মামলায় শিশুদের হয়রানীমূলক গ্রেফতার, সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা স্থানান্তর হওয়ার আগে পুলিশ থানা থেকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত পর্যন্ত মামলার প্রাথমিক পর্যায়ে দীর্ঘসুত্রিতা ও আসামিদের বিনা বিচারে হাজতবাস ইত্যাদি আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতিকে নির্দেশ করে। উপরন্তু, ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালের রেকর্ড থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালে থেকে ৩১ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬’ এবং ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’ এ করা যে মামলাগুলো বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরিত হয়েছিল, তাদের মধ্যে প্রায় ৪৫ শতাংশ মামলা ট্রাইব্যুনাল প্রথম শুনানিতে খারিজ করে দিয়েছিল। এই মামলাগুলোতে খারিজ হওয়ার আগ পর্যন্ত অনেক অভিযুক্ত ব্যক্তি গ্রেফতার হয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন। তাদের এই মিথ্যা হয়রানির কোন প্রতিকার ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬’ ও ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’ এ রাখা হয়নি, এবং প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনেও তা অনুপস্থিত।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি মানবাধিকারের মূলনীতিসমূহ ‘শ্রদ্ধা’, ‘সুরক্ষা’ ও ‘সমুন্নত’ রাখায় এবং গনতন্ত্রিক মুল্যবোধে বিশ্বাসী। বিএনপি মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির ১৯ অনুচ্ছেদ, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত কমিটি কর্তৃক ১৯ অনুচ্ছেদের ওপর ব্যাখ্যাদানকারী জেনারেল কমেন্ট ৩৪, জোহানেসবার্গ প্রিন্সিপলস অন ন্যাশনাল সিকিউরিটি, তছোয়ান (Tshwane) ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন অ্যান্ড এক্সেস টু ইনফরমেশন নীতিমালা, এবং সেই সাথে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের উল্লিখিত মৌলিক অধিকারসমূহ, তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ ইত্যাদি আইন ও মূলনীতিসমূহে বিশ্বাস করে। তাই বিএনপি মনে করে প্রস্তাবিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩’ অসাংবিধানিক, আইনের শাসন এবং মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার পরিপন্থী। শুধুমাত্র ‘সাইবার’ শব্দটি দিয়ে ‘ডিজিটাল’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করলেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের তৈরি করা ভয়ের সংস্কৃতি দূর হবে না।

বিএনপি আরও মনে করে একমাত্র জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সরকারই জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে ও প্রকৃত আইনের শাসন কায়েম করে। অন্যদিকে ছলচাতুরি করে ক্ষমতা দখল করে রাখা ফ্যাসিস্ট শক্তি জনগণকে আইন দ্বারা নিপীড়ন করে। নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজনের জন্য জনগণের দাবী অনুযায়ী সাংবিধানিক সংস্কার না করে আওয়ামী লীগ সরকার প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন ইত্যাদি প্রণয়ন করে জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনটি জনগণের সাথে আলোচনা না করে করেই ৭ আগস্ট ২০২৩ তারিখে মন্ত্রীসভায় অনুমোদন করা এবং ৯ আগস্ট আইনটির খসড়া অনলাইনে প্রকাশ করে নাগরিকদের মতামত দেয়ার জন্য মাত্র ১৪ দিন সময় দেয়ার কারণে ইতিমধ্যে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে হতাশা ও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এক সপ্তাহের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও সরকারের তরফ থেকে জনগণকে আশ্বস্ত করার কোন কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়েনি।

উপরোক্ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি নিম্নোক্ত দাবী করছেঃ

১। অবিলম্বে নিপীড়নমূলক এবং নিবর্তনমূলক ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮’ রহিত করবার বিল সংসদে উত্থাপন করে পাশ করা হোক।

২। প্রস্তাবিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩’ বিষয়ে পর্যালোচনা ও মতামত দেয়ার জন্য জনগণকে পর্যাপ্ত সময় দেয়া হোক।

৩। নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজনের পর গঠিত সরকার কর্তৃক সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ সহ অন্যান্য আইন নতুন নির্বাচিত সংসদে পাশ করা হোক এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য আইনি সংস্কার করা হোক।


বার্তা প্রেরক,

(মুহম্মদ মুনির হোসেন)

সহ-দফতর সম্পাদক

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি

রিলেটেড প্রোগ্রাম এবং প্রেস রিলিজ

আরো দেখুন