বাংলাদেশের জলবায়ু প্রভাব মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে অভিহিত করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বৃহস্পতিবার দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, সারাদেশে তীব্র তাপদাহ, অসহনীয় লোডশেডিং আর তীব্র পানির সংকট দেশের জনগণকে দেখিয়ে দিয়েছে, জানিয়ে দিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগই গ্রহণ করেনি।
এ সংক্রান্ত বক্তব্যের শুরুতেই আমি একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই- আপনাদের অনেকেরই নিশ্চয়ই মনে আছে, দুর্নীতিবাজ হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামী লীগ নেতা ম খা আলমগীরের নেতৃত্বে একটি আওয়ামী চক্র ২০১৩ সালে ফারমার্স ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিল। লুটপাট আর টাকা পাচারের অন্যতম নিরাপদ এই ব্যাংকে ২০১৫ সালে জলবায়ু তহবিলের প্রায় ৬’শ কোটি টাকা সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। আজ পর্যন্ত সেই টাকা জলবায়ু তহবিলে ফেরত দেয়া হয়নি। জলবায়ু মোকাবেলায় খরচ না করে, জলবায়ু তহবিলের টাকা কেন মখা আলমগীরের ব্যাংকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল?
তারেক রহমান বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। সুতরাং,তাপদাহ কিংবা দাবদাহ যাই বলিনা কেন, এর পেছনে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে বটে তবে হঠাৎ করেই কিন্তু এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো নানারকম প্রস্তুতি নিয়েছে। আর বাংলাদেশ? জলবায়ু তহবিলের টাকা লোপাট করার জন্য ফারমার্স ব্যাংক বানিয়েছে। দুর্নীতি, লুটপাট, টাকা পাচার শেষে নাম পরিবর্তন করে ফারমার্স ব্যাংক বিলীন হয়ে গেছে ‘পদ্মা’য়। ‘পদ্মা’ নাম ধারণ করা ব্যাংকটি এখন আবার নতুন করে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে বিলীন হচ্ছে। একের পর নাম পরিবর্তন হচ্ছে কিন্তু ফারমার্স ব্যাংকে সরিয়ে ফেলা জলবায়ু তহবিলের শত শত কোটি টাকা আদৌ কি আর ফেরত পাওয়া যাবে?
জলবায়ু তহবিলের অর্থ যথাযথ কাজে লাগানো হয়নি উল্লেখ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়েন্স ফান্ড কিংবা গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডে দেশি বিদেশী উৎস থেকে জমা হওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে নিয়েছে আওয়ামী লুটেরা চক্র। জলবায়ু তহবিলের টাকা মানেই যেন আওয়ামী লুটেরাদের লুটপাটের নিরাপদ খাত। বাংলাদেশে জলবায়ু তহবিলের টাকা খরচ করে নেয়া এমন একটি প্রকল্পও খুঁজে পাওয়া যাবেনা যেখানে লুটপাট দুর্নীতি হয়নি। জলবায়ু তহবিলের ফান্ডে পরিচালিত কমপক্ষে ৭ টি প্রকল্পের ব্যাপারে টিআইবি তথ্যানুসন্ধান চালিয়েছিল। টিআইবি প্রতিটি প্রকল্পেই দুর্নীতির পুকুরচুরি খুঁজে পেয়েছে। জলবায়ু তহবিলের টাকা লুটপাটের দিকে নজর থাকলেও জলবায়ু মোকাবেলায় বিনাভোটের সরকার কার্যতঃ কোনো কার্যকর উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, জলোচ্ছাস, নানা বিষয়ে তথ্য পেতে একটি আধুনিক কৌশল ও যন্ত্র সমৃদ্ধ ‘আবহাওয়া বিভাগ’ অনিবার্য। অথচ জানা যাচ্ছে- বর্তমানে দেশের আবহাওয়া বিভাগের একটি রাডারও কাজ করছেনা। তাহলে কিসের উন্নয়ন? কার উন্নয়ন? কাদের জন্য উন্নয়ন?
তারেক রহমান সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধমে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট উল্লেখ করে বলেন, রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের দুই পাশে বনসাই গাছ লাগানো হয়েছিল। কিন্তু পরিবেশবিদগণ বলেছিলেন, যেসব বনসাই গাছ লাগানো হয়েছে, এগুলো ঢাকার মাটি এবং পরিবেশের জন্য উপোযোগী নয়। তারপরও কিন্তু সড়ক ও জনপথ বিভাগ বিদেশ থেকে প্রচুর টাকা দিয়ে আমদানি করে এসব গাছ লাগিয়েছিল। আসলে পরিবেশ সংরক্ষণ কিংবা গাছ লাগানো মূল উদ্দেশ্য নয়। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, দুর্নীতি।
তিনি বলেন, জলবায়ু তহবিলের টাকা লুটপাটের পাশাপাশি চলছে প্রকৃতি এবং পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রম। এমনকি ভোট ডাকাত হাসিনা বিশ্ব ঐতিহ্যের ধারক ‘সুন্দরবন’ বিধ্বংসী প্রকল্প গ্রহণ করতেও দ্বিধা করেনি। উন্নয়নের নামে চট্টগ্রামে মনে হয় গাছ কাটার মহোৎসব চলছে। পাহাড় কাটা, পাহাড় দখল রোধে কোনো পদক্ষেপ নেই। সম্প্রতি ভবন নির্মাণের নামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চার শতাধিক গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। দেশ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিতে জেনেও তথাকথিত উন্নয়নের নামে গাছ গাছালি কেটে, খাল ডোবা জলাধারগুলো ভরাট করে, মাঠ পার্ক দখল করে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের শহরগুলোকে কংক্রিট আর আবর্জনার শহরে পরিণত করা হয়েছে।
তারেক রহমান বলেন, তাপদাহ কিংবা দাবদাহের সময় নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদ-নদী, হাওর-খালগুলো জনগণের জন্য একটি অন্যতম নিরাপদ আশ্রয় হতে পারতো। কিন্তু উজান থেকে নদী শাসন-শোষনের কারণে ভাটির বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো প্রায় সারাবছরই পানিশূন্য থাকে। আর এই সুযোগে আওয়ামী দখলদার চক্র পানিশূন্য খাল, নদ নদী দখল করে নিয়ে ভরাট করে ফেলছে। আওয়ামী দখলদার চক্রের দখলদারিত্ব থেকে রেহাই পেয়েছে দেশে এমন একটি নদী কিংবা খাল খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। আমি জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখছিলাম; রিপোর্ট বলছে- বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী ও কালীগঙ্গা নদীবেষ্টিত কেরানীগঞ্জ উপজেলায় খাল ছিল কমপক্ষে ৫২টি। এরমধ্যে দখল আর দূষণে ৪০টি খালই প্রায় বিলুপ্ত। আর ১২টি খাল কোনোমতে এখনো অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। দখলদার হাসিনা আরো কিছুদিন ক্ষমতা দখল করে রাখতে সক্ষম হলে দেখবেন এই ১২টি খালের অস্তিত্বও হয়তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে কমপক্ষে ১২ শতাধিক নদ-নদী ছিল। এরমধ্যে ৫ শতাধিক নদীর মৃত্যু হয়েছে। ১৯৭৪ সালে ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণের জেরে বাংলাদেশের নদ নদীর এই মরণ যাত্রা শুরু হয়েছিল। নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উজানে নদীর পানি এবং পলি প্রবাহে অব্যাহতভাবে বাঁধা সৃষ্টি, নদ নদীর অবৈধ দখল, অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা কারণে একের পর এক নদীগুলো মরে যাচ্ছে। একদিকে পানি প্রবাহ না থাকা, অন্যদিকে দখলদারিত্বের কারণে অনেক নদী প্রায় খালে রূপান্তরিত হয়েছে। অথচ জলবায়ু মোকাবেলায় বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো প্রাণসঞ্চারী ভূমিকা রাখতে পারতো। মানুষের বেঁচে থাকার স্বার্থেই দেশের নদ-নদী, খাল বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। নদ -নদী, খাল, জলাশয়, জলাধারগুলো দখলমুক্ত এবং সজীব রাখা রাষ্ট্রের বিশেষ দায়িত্ব হওয়া উচিত।
বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষিত থাকার কথা স্মরণ করিয়ে তারেক রহমান বলেন, দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে সংযোগ সড়ক, রেলসংযোগ, স্থলবন্দর ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট এর মতো ইস্যুগুলো দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই ইস্যুগুলো নিয়ে বাংলাদেশের সামনে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করার সুযোগ ছিল। কিন্তু ক্ষমতালিপ্সু হাসিনা তার বিনাভোটের সরকারের প্রতি সমর্থন আদায় করতে, দেশের স্বার্থে নয়, এই ইস্যুগুলোকে তার ব্যক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছে। ফলে তিস্তা চুক্তি কিংবা অভিন্ন নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের বিষয়টি এখনো অমিমাংসিত। সুতরাং, নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলাদেশের জলবায়ু প্রভাব মোকাবেলায় খোদ হাসিনাই এখন সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের দেশ বিনির্মাণের কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় আমরা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের একটি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন যুগান্তকারী খাল খনন এবং বৃক্ষরোপন কর্মসূচির কথা স্মরণ করতে পারি। ‘খাল কাটা হলে সারা, দূর হবে বন্যা খরা’ এই শ্লোগান নিয়ে শহীদ জিয়া সারাদেশে খাল খনন এবং বৃক্ষরোপন কর্মসূচির মাধ্যমে দেশে সবুজ বিপ্লব শুরু করেছিলেন। ‘মাদার অফ ডেমোক্রেসি’ খালেদা জিয়ার সরকারের সময়েও সবুজায়ন কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জনগণের রায়ে বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় এলে জলবায়ু মোকাবেলায় দেশে আবারো শহীদ জিয়ার সেই সবুজ বিপ্লব কর্মসূচি পুনরায় শুরু করা হবে।
দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, একটু চিন্তা করে দেখুন। আওয়ামী লুটেরা চক্র বিদেশে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছে। কানাডায় বেগম পাড়া বানিয়েছে। আওয়ামী লুটেরা চক্র যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে শত শত অগণিত ঘরবাড়ি বানিয়েছে। সুতরাং, বসবাসের জন্য বাংলাদেশ অনিরাপদ হয়ে উঠলে আওয়ামী লুটেরা চক্র নিরাপদে বিদেশে পালিয়ে যাবে। কিন্তু সাধারণ জনগণ কোথায় যাবে? দেশের কোটি কোটি জনগণ আমাদের বিদেশে যাদের সেকেন্ড হোম নেই, আমাদেরকে বাংলাদেশেই থাকতে হবে।পরিবেশ বিরোধী হাসিনার দুঃশাসনের এই দহনকালে গণতন্ত্র কিংবা মানবাধিকার দূরে থাক, প্রকৃতি এবং পরিবেশও নিরাপদ নয়। বাংলাদেশ নিরাপদ নয়। সুতরাং, জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলা করে আপনার-আমার, আমাদের সবার জন্য একটি নিরাপদ এবং বসবাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। একটি নিরাপদ বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের পক্ষের শক্তি, গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখতে হবে।