আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে রবিবার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মানববন্ধন করেছে বিএনপি। তবে অন্তত ৭টি জেলায় বিএনপি’র মানববন্ধন কর্মসূচিতে হামলা চালিয়েছে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। হবিগঞ্জে মানববন্ধনে বাধা দিলে পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশের গুলিতে সাংবাদিকসহ শতাধিক বিএনপি নেতাকর্মী আহত হন। বিএনপি নেতাকর্মীদের ইটপাটকেলে কয়েকজন পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছেন।
রাজধানীতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিএনপি’র মানববন্ধন কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়। গ্রেপ্তার আতঙ্ক উপেক্ষা করে সকালে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বিএনপি নেতাকর্মীরা জড়ো হন সেখানে। মানববন্ধন শুরুর আগেই লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে প্রেস ক্লাব এলাকা। এতে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা ছাড়াও থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের কয়েক হাজার নেতাকর্মী ও ‘গুম’-খুনের শিকার নেতাকর্মীদের স্বজন ও কারাবন্দি নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্যরা অংশ নেন। এ ছাড়া একই সময়ে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা শরিক দল ও জোটগুলো রাজধানীতে মানববন্ধন করেছে।
মানববন্ধনে সভাপতির বক্তব্যে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান সরকারের বিরুদ্ধে দেশের জনগণকে ‘না’ বলার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ আজকে রাস্তায় নেমে পড়েছে, মিছিলে মিছিলে সারা বাংলাদেশ আপ্লুত।
আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যিনি বিএনপিকে সংগঠিত করে নতুন করে দাঁড় করিয়েছেন তার আহ্বান, আপনারা যে যেখান থেকে পারেন সরকারের বিরুদ্ধে ‘না’ বলুন। সরকারের কোনো কিছুতে অংশগ্রহণ করবেন না। এমনকি দোকানপাট শ্রমিক যারা আছেন সবাই দোকানপাট বন্ধ করে দিন, আপনাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করে দিন, আপনাদের বিয়ে-শাদীর পার্টিগুলো ছোট করে দিন। আজকে পিয়াজের দর ২২০ টাকা হয়েছে, আজকে জিনিসপত্রের দামে আগুন। আমাদের মানুষ না খেয়ে মরছে। এই নেতাকর্মীরা যারা আজকে পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারছে না, যারা আজকে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের কথা চিন্তা করে আপনারা আসুন, আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হই। আপনারা দেখবেন শিগগিরই জনগণ এই ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটাবে।
সেলিমা রহমান বলেন, জনগণের প্রতি আহ্বান রইলো আপনারা নেমে আসুন। নেমে এসে প্রতিরোধে-প্রতিবাদ গড়ে তুলুন। আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছি। তারা (ক্ষমতাসীনরা) লাঠিয়াল বাহিনী, হেলমেট বাহিনী তৈরি করে জনগণের ওপর অত্যাচার করছে। এটা বেশি দিন চলবে না। আমি বলবো, মনে সাহস রাখুন। আমরা রাজপথে আছি, রাজপথে থাকবো। মিছিলে মিছিলে সারা বাংলাদেশ ভরিয়ে দেবো তবুও এই সরকারের নির্বাচন আমরা মানবো না। ২৮শে অক্টোবরের মহাসমাবেশ পণ্ড করে দেয়ার পর থেকে দলের নেতাকর্মীদের ওপর দমনপীড়নের চিত্র তুলে ধরে সেলিমা রহমান বলেন, ওরা আমাদের মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতাদের শুধু কারারুদ্ধই করেনি, তাদের জামিন পাওয়ার যে ন্যায্য অধিকার সেটা পর্যন্ত দেয়া হচ্ছে না। আজকে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ দলীয়করণ করে বিচারকরা একজনের নির্দেশে চলছে। সেই নির্দেশ হলো দেশ যিনি শাসন করছে যিনি অবৈধভাবে ভোটারবিহীন অবস্থায় বাংলাদেশের সরকারে জোর করে বসে আছে তিনিই সব নির্দেশ করছেন। আজকে এমন অবস্থা হয়েছে যে, বাবাকে না পেলে ছেলেকে নিয়ে যায়, ছেলেকে না পেলে মাকে নিয়ে যায়। গতকাল মানববন্ধন করেছে মায়ের ডাক। সেখানে একজন মহিলা বললো, তার বিরুদ্ধে মার্ডার কেস দুইটা দেয়া হয়েছে সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এই হলো দেশের অবস্থা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি। বাংলাদেশের মানুষের ওপর যত নিপীড়ন হচ্ছে এরকম নিপীড়ন বোধহয় আর কোথাও নাই। মানবাধিকার লঙ্ঘনে এখন বাংলাদেশ এক নম্বরে। গত ২৮শে অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এভাবে সর্বগ্রাসী দানব বাংলাদেশ পরিচালনা করছে।
বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে আজকে বাংলাদেশে মানবাধিকার ভূলণ্ঠিত, মানুষের অধিকার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন কোথাও নেই। এই অবস্থায় সকলকে সোচ্চার হতে হবে, সকলকে অন্যায়-অবিচার-কুশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। নেতাকর্মী সকলকে ভয়ভীতি উপেক্ষা করে আগামীদিনে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যে সংগ্রাম চলছে সেই সংগ্রামকে আরও শানিত করার জন্য আজকে যেমন রাস্তায় নেমে এসেছেন, ইনশাআল্লাহ স্বৈরাচারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আপনারাসহ আমরা রাস্তায় থাকবো।
বিএনপি’র আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, গুম-খুন ও হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। আজকে দেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকার নেই। নিম্ন আদালতে রায় পড়ে শোনানো হচ্ছে। মৃত ব্যক্তিকেও সাজা দেয়া হচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মানবাধিকার রাষ্ট্রীয়ভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এই ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরে যাবো না।
বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা কাদের গণি চৌধুরীর সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা জয়নুল আবদিন ফারুক, অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম, তাহসিনা রুশদীর লুনা, শিরিন সুলতানা, মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, রেহানা আখতার রানু, মীর নেওয়াজ আলী, হুম্মাম কাদের চৌধুরী, আফরোজা আব্বাস, সুলতানা আহমেদ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সকাল ১১টায় শুরু হওয়া মানববন্ধন বেলা ১২টার আগেই শেষ হয়।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সিনিয়র নেতা রুহুল আমিন গাজীর নেতৃত্বে আলাদা মানববন্ধন হয়। সেখানে পেশাজীবী নেতারা বক্তব্য রাখেন। পেশাজীবী নেতাদের মধ্যে অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস, ডা. সিরাজুল ইসলাম, আব্দুল হাই সিকদার, রিয়াজুল ইসলাম রিজু, শহীদুল ইসলাম, অধ্যাপক গোলাম হাফিজ কেনেডি, অধ্যাপক কামরুল ইসলাম, সাংবাদিক রাশেদুল হক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়া গণতন্ত্র মঞ্চ কাওরান বাজারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অফিসের সামনে, ১২ দলীয় জোট, গণধিকার পরিষদ বিজয়নগরে পানির ট্যাংকের সামনে, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট পুরানা পল্টনে আল-রাজী কমপ্লেক্সের সামনে, এলডিপি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে, গণফোরাম-পিপলস পার্টি কদম ফোয়ারার কাছে, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, জাতীয় প্রেস ক্লাবের উল্টো দিকে, লেবার পার্টি তোপখানা রোডে মেহেরবা প্লাজার সামনে, গণঅধিকার পরিষদ (রেজা কিবরিয়া) পুরানা পল্টনে দলের কার্যালয়ের সামনে, এবি পার্টি বিজয়নগরে ৭১ হোটেলের সামনে আলাদা আলাদাভাবে মানববন্ধন কর্মসূচি করে।
এদিকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার ও জেলা প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, হবিগঞ্জে বিএনপি’র মানববন্ধন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে।
ওদিকে ফরিদপুরে বিএনপি’র মানববন্ধন শুরুর পর পরই পুলিশের বাধায় পণ্ড হয়েছে। এ সময় পুলিশ মানববন্ধনের ব্যানার কেড়ে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি নেতারা।
ঠাকুরগাঁওয়ে পুলিশের বাধায় সড়কে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করতে পারেননি মহিলা দলের নেতাকর্মীরা।
বরিশালে বিএনপি’র মানববন্ধন কর্মসূচি পুলিশের বাধায় পণ্ড হয়ে গেছে। সকাল থেকেই বিপুলসংখ্যক পুলিশ নগরের সদর রোড, কাকলি মোড়সহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেয়। এ সময় বাধা উপেক্ষা করে কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করলে পুলিশের ধাওয়ায় নেতাকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। এরপর নেতাকর্মীরা পুনরায় মিছিল বের করলে পুলিশ মিছিলকারীদের ধাওয়া দেয়।
এদিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর বিএনপি’র মানববন্ধন কর্মসূচি আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের বাধার মুখে পণ্ড হয়ে গেছে। এ সময় মানববন্ধনের ব্যানার ছিনিয়ে নেয়া হয়। এ ছাড়া মুন্সীগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলা বিএনপি’র অঙ্গসংগঠনের মানববন্ধনও পুলিশের বাধায় পণ্ড হয়ে গেছে।