image

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংকিং ও অন্যান্য খাত থেকে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে অভিযোগ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি দেশি-বিদেশী বিভিন্ন গবেষণা এবং প্রতিষ্ঠানের দেয়া তথ্য তুলে ধরে বলেন, এই অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকারের লোকজনের লুটপাট, বিদেশে টাকা পাচার, ব্যাংকিং খাতে চরম অব্যবস্থাপনা, লাগামহীন দুর্নীতির কারণে দেশের অর্থনীতি ‘ফোকলা’ বা ‘ফাঁপা’ হয়ে গেছে। গতকাল শুক্রবার এক দলের চেয়ারম্যানের গুলশান কার্যালয়ে আয়োচিত সংবাদ সম্মেলনে বিগত ১৫ বছরের অর্থনীতির অবস্থা তুলে ধরে তিনি এ অভিযোগ করেন।

এ সময় সরকারের উন্নয়নের নামে লুটপাটের চিত্র তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, এটা একদম পুরোপুরি একটা হলফ, ফাঁপা একটা বিষয়। অর্থনীতি ফোকলা হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে পুরো সম্পদ তারা লুট করে নিয়ে চলে গেছে। সেই সম্পদ বিদেশে নিয়েছে, বাড়ি-ব্যবসা করছে। বিভিন্ন পত্রিকা ও অন্যান্য নির্ভরযোগ্য সূত্র মারফত আমাদের জানামতে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের ১২ অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাংকিং ও অন্যান্য খাত থেকে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে, একেবারে লুট। তিনি বলেন, এখানে এই লোকগুলোর (ক্ষমতাসীনদের) কোনো নতুন বিনিয়োগ নেই, দেশে কোনো নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। যার ফলে দারিদ্র্য দারিদ্র্যই থেকে যাচ্ছে এবং মানুষের যে আয়ের ফারাকটা, বৈষ্যমটা যেটা সেটা দিনে দিনে বাড়ছে। এমন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এখন একটা পয়েন্ট অব রিটার্নে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সিপিডি বলছে, এখানে দুটি সোসাইটি তৈরি হয়ে গেছে একটা হচ্ছে খুবই বড়লোক শ্রেণি যারা বিদেশে যায়, পোশাক-আশাক, দামি গাড়ি বিএমডব্লিউ, মার্সিটিজ এগুলোতে চড়ছে। অন্যদিকে এই গুলশানেই দেখবেন সিগন্যালগুলোতে ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে অসংখ্য মানুষ তারা তাদের প্রতিদিনের খাবার সংগ্রহ করতে পারে না। এটাই বাস্তবতা।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, আর্থিক খাতসহ দেশে আইনের শাসন ও সার্বিক শৃংখলার অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে জবাবদিহি। যেহেতু বর্তমান ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের জনগণের কাছে কোনো জবাবদিহি নেই, তাদের হাতে আমাদের এই দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, বিচারব্যবস্থা কোনো কিছুই নিরাপদ নয়। আপনাদের মাধ্যমে প্রিয় দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহ্বান- আসুন বাংলাদেশে একটি সত্যিকার জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে চলমান গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি এবং দুঃসহ আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের অবসান ঘটিয়ে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করি; তাহলেই ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিতামূলক সরকার ব্যাংকিং সেক্টর তথা সামগ্রিক অর্থনীতিকে চরম বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করে টেকসই উন্নয়ন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবো।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, এই অবৈধ সরকার শুধু রাজনীতিকে নয়, অর্থনীতিকেও পুরোপুরি ধবংস করেছে এবং তারা মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে, প্রতারণা করছে জনগণের সঙ্গে। জনগণ শুধু নয়, আন্তর্জাতিক যে সংস্থাগুলো আছে সেই সংস্থাগুলোর সঙ্গেও তারা প্রতারণা করছে। এমন একটা ন্যারেটিভ খাঁড়া করেছে যে, বাংলাদেশ রোল মডেল হয়ে গেছে যে, থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিগুলোর ডেভেলপমেন্টের জন্য বারবার এই কথাটা বলতে থাকে, জোর দেয় এবং বিভিন্ন সেতু, উড়ালসেতু, টানেল, মেট্রোরেল উদ্বোধন করার মধ্য দিয়ে এই বিষয়টি বলতে চায় যে এটা উন্নয়নের দিকে চলে গেছে। আপনি দেখবেন যে, এটা আমার কথা নয়, আমি যদিও অর্থনীতির ছাত্র কিন্তু অন্যান্য যে অর্থনীতি বিষয়ক যেসব সংস্থা আছে যারা রিসার্চ করে, পড়াশুনা করে বলছে- এটা পুরোপুরিভাবে হলফ, ফাঁপা একটা বিষয়। জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে।

মির্জা ফখরুল আরো বলেন, ব্যাংকিং খাত নজিরবিহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণেই আমাদের অর্থনীতির মেরুদ- সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না। মূলত সরকারের পলিসিগত বা রাজনৈতিক দুর্বলতা এবং ব্যক্তিস্বার্থ বা সর্বগ্রাসী লুটপাট আমাদের অর্থনীতির জীবনীশক্তিকে ক্রমেই ধ্বংস করে দিচ্ছে। যার সর্বশেষ সংযোজন কেবল দুর্নীতি ও রাজনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন নামে একটি বিশেষ গ্রুপ তথা ইচ্ছাকৃত লোন ডিফল্টারদের হাতে নিয়মবহির্ভূতভাবে জনতা ব্যাংক ২২ হাজার কোটি টাকা তুলে দিয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটেছে ইসলামী ব্যাংকে। একটি শিল্পগ্রুপ নামে- বেনামে অস্তিত্বহীন ভুয়া কোম্পানির নামে কেবল ইসলামী ব্যাংক থেকেই ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। অথচ গ্রুপটি সর্বোচ্চ ২১৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার যোগ্য। এই গ্রুপটি ন্যূনতম এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার করেছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের যোগাযোগ ও ক্ষমতা থাকলে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা লুটপাট এখন সবচেয়ে সহজ বলে মন্তব্য করেছেন একজন অর্থনীতিবিদ। দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে যারা বিদেশে বিপুল বিত্ত-বৈভবের পাহাড় গড়েছে, একজন অর্থনীতিবিদ তাদের জাতীয় দুশমন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারা ব্যাংকিং সিস্টেমের অপব্যবহার করে ব্যাংকঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করে চলেছেন। তারা রাজনীতিক পরিচয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, সাধারণত কোনো দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটলে বিদেশি ব্যাংকগুলো সেখানে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ছুটে আসে। ২০০৯ সাল থেকে দেশে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় ১৩টি বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হলেও কোনো বিদেশি ব্যাংক কি বাংলাদেশে এসেছে? উল্টো যে কয়েকটি বিদেশি ব্যাংক বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তারাও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করছে। একই ধরনের প্রোডাক্ট ও সেবা নিয়ে ব্যাংকিং সেবা দেওয়ার প্রতিযোগিতা করছে দেশের ৫২টি ব্যাংক। তিনি বলেন, গত বছরের জুলাইয়ে দেশের ব্যাংকগুলোয় পণ্য আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছিল ৬ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন বা ৬৩৫ কোটি ডলারের। কিন্তু চলতি বছরের জুলাইয়ে ব্যাংকগুলো মাত্র ৪৩৭ কোটি ডলারের নতুন এলসি খুলতে পেরেছে। এ হিসাবে অর্থবছরের প্রথম মাসে ব্যাংকগুলোয় আমদানি এলসি খোলা কমেছে ৩১ শতাংশেরও বেশি। অর্থাৎ দেশের অর্থনীতি এখন নজিরবিহীন মন্থরগতিতে চলছে। কাঁচামাল এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। বিনিয়োগ কমছে এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও কমছে। আমদানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য এটা এক মহাচ্যালেঞ্জ। তার ওপর রয়েছে স্বার্থান্বেষীদের সিন্ডিকেট। মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। অনেকের সঞ্চয়ও শেষ। নিম্নবিত্তের নাভিশ্বাসতো আছেই।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, সরকার ও তাদের অবৈধ সুবিধাভোগীরা দেশকে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। আর দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ বিদেশে পাচার করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্যমতে, আমদানি ও রপ্তানি পণ্যমূল্যের মিস ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে কর ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন দেশে অর্থপাচার করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এভাবে প্রতিবছর গড়ে ৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছে বাংলাদেশ। এভাবে ৯ বছরেই দেশ থেকে ৭৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। জিএফআই ২০১৫ সালে বলেছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর সরকারের সিআইডি বরাতে দেশের পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশ হয়, শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে গড়ে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। হুন্ডির সঙ্গে ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো মূল সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যায়, প্রতিবছর বর্তমানে কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। রপ্তানির আড়ালেও সম্প্রতি ১৪শ কোটি টাকা বিদেশে পাচার এবং ইডিএফের আড়ালে ৭০০ কোটি ডলারের দুর্নীতির অভিযোগ যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। তিনি আরো বলেন, ‘বিগ থ্রি’ হিসেবে পরিচিত বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী তিনটি রেটিং এজেন্সি বাংলাদেশের ঋণমান যেভাবে হ্রাস করেছে। নেতিবাচক সংকেত দিয়েছে তাতে অর্থনীতি রেড ফ্ল্যাগস এ উঠে এসেছে। গত মে মাসে বৈশ্বিক রেটিং এজেন্সি মুডিস বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং বিএ৩ থেকে নামিয়ে বি১ -এ পুননির্ধারণ করেছে। যেখানে প্রতিটি দেশ ক্রমান্বয়ে ভালো রেটিং পাওয়ার চেষ্টা করে থাকে, সেখানে গত একযুগ পর এই মান কমানো দেশের অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। গত জুলাইয়ে বাংলাদেশের রেটিং আউটলুক হ্রাস করেছে আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। তারা বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক ঋণমান নির্ধারণ করেছে। সর্বশেষ ফিচ রেটিংসও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নেতিবাচক ঘোষণা করেছে। অর্থনীতি ভঙ্গুর ও অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। বিদেশি ঋণ প্রদানকারী ও বিনিয়োগকারীরা আর আস্থা রাখতে পারছে না। দেশের এ অর্থনৈতিক দুরবস্থা একদিনে সৃষ্টি হয়নি, অবৈধ সরকারের উন্নয়নের নিচে চাপা পড়েছিল, যা এখন বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। বাস্তব অবস্থা আরও ভয়াবহ।

ব্যাংকে নজিরবিহীন তারণ্য সংকটের চিত্র তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, বেশ কিছুকাল থেকেই তারল্য সংকটে পড়ে দেশের অনেক ব্যাংক ধার করে চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য কমে তিন হাজার ৯০৯ কোটি টাকায় নেমেছে। এক বছর আগেও যা দুই লাখ তিন হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা ছিল। বিশেষ করে শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত পাঁচটি ব্যাংক নিয়মিত সিআরআর রাখতে ব্যর্থ হয়ে জরিমানায় পড়েছে। এ সময়ে নিরাপত্তার কথা ভেবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখছেন অনেকে। কিন্তু তারল্য সংকটে অনেক ব্যাংক আমানতকারির নিজস্ব আমানতের এমনকি এক লাখ টাকার চেকও অনার করতে পারছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান রবকত উল্লাহ বুলু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন ও নির্বাহী কমিটির সদস্য নাজিম উদ্দিন আলম উপস্থিত ছিলেন।