বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ২১ আগস্ট, ওয়ান ইলেভেন, পিলখানায় সেনা হত্যাযজ্ঞ একটি ঘটনাকে আরেকটি ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই।
সোমবার (২১ আগস্ট) দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেওয়া ভার্চুয়াল বক্তব্যে তিনি এই কথা বলেন। তিনি বলেন, জনগণ বিশ্বাস করে দেশকে তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই দেশে বিদেশে জাতীয়তাবাদী শক্তির ইমেজ ক্ষুন্ন করতে ২০০৪ সালে ২১ আগষ্টের ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। ২১ আগস্ট ছিল দেশের জাতীয়তাবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্র।বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ২১ আগস্টের নৃশংস ঘটনাটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। ‘একুশে আগস্ট’ আর ‘ওয়ান ইলেভেন’ একই সূত্রে গাঁথা। ২১ আগস্ট ছিল ২০০৭ সালের কথিত ‘ওয়ান ইলেভেন’ সৃষ্টির মহড়া।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলাকে ভয়ঙ্কর ও জঘন্যতম উল্লেখ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, প্রতি বছর ২১ আগষ্টের জঘন্যতম ঘটনা নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাপক আলোচনা হয়, নানারকম অনুষ্ঠান হয়। তবে ২১ আগষ্টের চেয়ে আরো ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু কেন রাষ্ট্রীয় আয়োজনে প্রতিবছর পিলখানায় বর্বরতম সেনা হত্যাযজ্ঞ দিবসে কোনো আলোচনা হয় না?
তারেক রহমান ২১ আগষ্টের হামলা মামলা নিয়ে আওয়ামী লীগের রহস্যময় তৎপরতা, কথিত ‘জজ মিয়া’কে নিয়ে আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যমূলক প্রোপাগান্ডা এবং দলীয় পুলিশ কর্মকর্তা দিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাঁকে (তারেক রহমানকে) এ মামলায় জড়ানো হয়েছে এসব বিষয় তুলে ধরেন। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, প্রয়াত সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের কাছ থেকে দু’দিন আগেই ২১ আগষ্টের সমাবেশে হামলার আশংকার কথা জানার পর শেখ হাসিনা কি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন?
তারেক রহমান বলেন, ‘দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণই আমার রাজনৈতিক আশ্রয়’ । তাই ২১ আগষ্টের নির্মম ঘটনাটি ঘিরে কিছু প্রশ্ন জনগণের আদালতে উপস্থাপন করতে চাই’।
তারেক রহমান বলেন, ২১ আগস্ট সম্পর্কে আলোচনা উঠলেই ‘জজ মিয়া’ নামে এক ব্যক্তির গ্রেফতার প্রসঙ্গটি সামনে এনে পুরো বিষয়টিকে সম্পূর্ণ ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্ট চালানো হয়। অথচ, সকল তদন্তেই ২১ আগষ্টের মুখ্য চরিত্র গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার মুফতি হান্নান। বিএনপি সরকারের আমলেই ২০০৫ সালের পহেলা অক্টোবর মুফতি হান্নানকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে ২০০৫ সালের ৯ জুন গ্রেফতার হয় জজ মিয়া নামে একব্যক্তি। গ্রেফতার হওয়ার সপ্তাহ দুয়েক পর ২৫ জুন ‘জজ মিয়া’ ২১ আগস্ট মামলায় নিজেকে জড়িয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। ‘জজ মিয়া’র স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ‘মুফতি হান্নানের নাম ছিল না।
তারেক রহমান বলেন, চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো তদারকি করার জন্য বিএনপি সরকারের সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি ‘জাতীয় মনিটরিং সেল’ করা হয়েছিল। জজ মিয়া’র জবানবন্দির আলোকে মামলা এগিয়ে নেয়ার জন্য তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারা দু’দফায় জাতীয় মনিটরিং সেলের কাছে নির্দেশনা চেয়েছিলো। কিন্তু ২১ আগস্ট মামলার তদন্ত চলাকালে তৎকালীন বিএনপি সরকার শুধু ‘জজ মিয়া’র জবানবন্দির উপর তদন্ত সীমাবদ্ধ রাখেনি। বরং জাতীয় মনিটরিং সেলের পক্ষ থেকে আরো গভীরভাবে তদন্ত এগিয়ে নেয়ার জন্য পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হয়। এরই জের ধরে ‘জজ মিয়া’ গ্রেফতারের পর তিনমাসের মাথায় মুফতি হান্নানের গ্রেফতারে প্রমাণিত হয়, বিএনপি সরকারের তদন্ত সঠিক ভাবেই এগুচ্ছিলো।
তিনি আরো বলেন, ‘জজ মিয়া’কে ব্যবহার করে ২১ আগস্ট মামলা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে চাইলে বিএনপি সরকারের সময় মুফতি হান্নানকে গ্রেফতারের প্রয়োজন ছিল না। ‘জজ মিয়া’কে ব্যবহার করে মামলা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে চাইলে বিএনপি সরকারের আমলেই পুলিশ ‘জজ মিয়া’কে অভিযুক্ত করে চার্জশীট দিতে পারতো। ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলা মামলাটিকে জাতীয় স্বার্থেই বিএনপি সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলো। তদন্ত পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় তাড়াহুড়ো করে বিএনপি সরকারের আমলে ২১ আগষ্ট হামলা মামলার কোনো চার্জশীট দাখিল করা হয়নি।
তারেক রহমান বলেন, যেখানে মামলার ১ নম্বর আসামী মুফতি হান্নানকে বিএনপি সরকারই গ্রেফতার করেছে, সেখানে ‘জজ মিয়া’কে ইস্যু বানিয়ে ২১ আগস্ট মামলার তদন্ত সম্পর্কে বিএনপির বিরুদ্ধে জনগণকে বিভ্রান্ত করার পেছনে আওয়ামী লীগের অবশ্যই ভিন্ন কারণ রয়েছে। সুতরাং, ২১ আগষ্টের ভয়ঙ্কর হামলার নেপথ্য কারণ বের করতে হলে ‘জজ মিয়া’ থেকে বেরিয়ে এসে আরো অনেক প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেতে হবে।
তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করে তারেক রহমান বলেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশ রাজধানীর ‘মুক্তাঙ্গনে’ হওয়ার কথা ছিল। সমাবেশের জন্য ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ লিখিতভাবে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন থেকে ‘মুক্তাঙ্গন’ বরাদ্দ নেয় । ‘মুক্তাঙ্গন’ বরাদ্দ পাওয়ার পর তৎকালীন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন উপ-দপ্তর সম্পাদক শহিদুল ইসলাম মিলন ২০০৪ সালের ১৭ আগস্ট লিখিতভাবে ঢাকা মহানগর পুলিশকে জানায়। ঢাকা মহানগর পুলিশ যথারীতি আওয়ামী লীগকে ১৯ আগস্ট লিখিতভাবে ‘মুক্তাঙ্গনে’ সমাবেশের সম্মতিপত্র দিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট প্রায় সকল জাতীয় পত্রিকায় ‘আজ মুক্তাঙ্গনে আওয়ামী লীগের সমাবেশ’ শিরোনামে সংবাদও প্রকাশিত হয়। ২১ আগস্ট নির্ধারিত সমাবেশের দিন বেলা ১২ টার মধ্যেই পুলিশ প্রশাসন ‘মুক্তাঙ্গন’ ও এর আশেপাশের এলাকায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
তবে পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা ‘মুক্তাঙ্গনে’র যাওয়ার কিছু সময় পর জানতে পারেন সমাবেশের স্থান কাউকে না জানিয়েই হঠাৎ করেই ‘মুক্তাঙ্গন’ থেকে গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের সামনে স্থানান্তর করা হয়েছে।
ভেন্যু স্থানান্তরের বিষয়ে প্রশ্ন উথাপন করে তারেক রহমান বলেন, যেই সমাবেশের প্রধান অতিথি সেই সময়কার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা, সেই সমাবেশের ‘ভেন্যু’ কার সিদ্ধান্তে পরিবর্তন করা হয়েছে? কে পরিবর্তন করেছে?
তিনি বলেন, তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া হয়, ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার সমাবেশে হামলার আশংকায় ‘মুক্তাঙ্গনে’র পরিবর্তে সমাবেশের স্থান পরিবর্তন করে ‘বঙ্গবন্ধু এভিন্যু’ এলাকায় স্থানান্তর করা হয়েছিল। তাহলে সেই ‘ভেন্যু’ পরিবর্তনের তথ্য কি আইন শৃংখলাবাহিনীকে জানানো হয়েছিল?
তারেক রহমান বলেন, ২১ আগষ্ট শেখ হাসিনার সমাবেশে হামলার ঘটনা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অবশ্যই অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এবং নৃশংস ঘটনা। এমন একটি ভয়ঙ্কর হামলার ঘটনা সাধারণত ‘পূর্ব পরিকল্পনা ও নিখুঁত নিশানা নির্ধারণ’ ছাড়া হতে পারেনা। সেক্ষেত্রে সমাবেশে গ্রেনেড হামলাকারীদের অবশ্যই ‘ভেন্যু’ সম্পর্কে আগেভাগেই স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট ধারণা থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
এ প্রসঙ্গে ২১ আগস্ট হামলা মামলা সম্পর্কে গণমাধমে প্রকাশিত রিপোর্টের কথা তুলে ধরে তারেক রহমান বলেন, পুলিশ এবং হামলাকারিদের জবানবন্দির বরাতে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে , শেখ হাসিনা সমাবেশে প্রথমে ‘আবু জান্দাল এবং কাজল’ গ্রেনেড ছুড়ে মারে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলাকারীদের কয়েকজনের জবানবন্দির আলোকে ‘যারা যেভাবে পরিকল্পনা ও হামলা করেছিল’ শিরোনামে ২০১৮ সালের ২১ আগস্ট দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই রিপোর্টে বলা হয়, ‘হামলার আগের দিন ২০ আগস্ট কাজল ও আবু জান্দাল ‘বঙ্গবন্ধু এভিন্যু’তে গিয়ে এলাকা পর্যবেক্ষণ (রেকি) করে আসেন’।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, রহস্যটি এখানেই। হামলাকারী জঙ্গি- সন্ত্রাসীরা সমাবেশেস্থল ‘মুক্তাঙ্গনে’র পরিবর্তে কেন ‘বঙ্গবন্ধু এভিন্যু’ পর্যবেক্ষণ করলো? ২১ আগস্ট দুপুরে হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগের সমাবেশের ভেন্যু ‘মুক্তাঙ্গন’ থেকে পরিবর্তন করে ‘বঙ্গবন্ধু এভিন্যু’তে নেয়া হলো? তাহলে হামলাকারীরা আগেই কিভাবে জানলো, মুক্তাঙ্গনে নয় সমাবেশ হবে ‘বঙ্গবন্ধু এভিনিউ’? হামলাকারীদেরকে ভেন্যু পরিবর্তনের তথ্য আগেই কে জানিয়ে দিয়েছে?
তারেক রহমান বলেন, ২১ আগষ্টের ঘটনার নেপথ্য কারণ জানতে হলে এইসব প্রশ্নের জবাব জানা প্রয়োজন। তবে হীন দলীয় স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থ বড় করে না দেখলে কখনোই এ সব প্রশ্নের জবাব মিলবে না।
বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার পর একযুগ পেরিয়ে গেলেও বর্তমান মাফিয়া সরকার একটি তদন্ত প্রতিবেদন এখন পর্যন্ত আদালতে দাখিল করতে সক্ষম হয়নি। আট বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও আদালতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ফান্ড ডাকাতি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি কিংবা করেনি।
আগস্ট হামলা মামলার অভিযোগপত্র নিজেদের ইচ্ছেমতো বানাতে কিশোরগঞ্জের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল কাহহার আকন্দকে পুলিশে ফিরিয়ে এনে তাকে ২১ আগস্ট মামলার অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়।
উল্লেখ্য, বিগত বিএনপি সরকারের আমলে পুলিশের চাকুরী থেকে অবসরে গিয়েছিলেন আব্দুল কাহহার আকন্দ। চাকুরী থেকে অবসরে গিয়ে আব্দুল কাহহার আকন্দ কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে গিয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যক্রমে সক্রিয় হয়েছিলেন। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নও চেয়েছিলো আব্দুল কাহহার আকন্দ। তবে আওয়ামী লীগ তাকে এমপি মনোয়ন দেয়নি।
তারেক রহমান আরো বলেন, ‘২১ আগস্ট হামলা মামলায় কোনোভাবেই আমাকে জড়ানোর কোনো তথ্য প্রমান না পেয়ে যেকোনোভাবেই হোক আমাকে জড়ানোর জন্য এসপি আকন্দ শুধুমাত্র ২১ আগস্ট হামলা মামলায়ই মুফতি হান্নানকে ৪১০ দিন রিমান্ডে নেয়। রিমান্ডের নামে আকন্দের নির্যাতন সেল থেকে মুক্ত হয়ে ২০১১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আদালতকে মুফতি হান্নান লিখিতভাবে জানায়, নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে তার কাছে ২১ আগস্ট মামলায় তার মুখ থেকে আমার নাম আদায় করা হয়েছে’।
তারেক রহমান প্রশ্ন করে বলেন, ‘যার মুখ থেকে আমার নাম বের করে ২১ আগস্ট মামলায় আমাকে জড়ানো হয়েছে, সেই মুফতি হান্নানকে অবশ্যই আদালতের কাঠগড়ায় আমার আইনজীবী ‘ক্রস এক্সামিন’ করার সুযোগ পাবে, এটিই আইনের নিয়ম। অথচ, ২১ আগস্ট মামলায় আমার আইনজীবীকে আদালতের কাঠগড়ায় ‘মুফতি হান্নান’কে ‘ক্রস এক্সামিন’ করার সুযোগ না দিয়ে কি কারণে অন্য একটি মামলায় মুফতি হান্নানকে তড়িঘড়ি করে ফাঁসি দেয়া হলো’?
তারেক রহমান বলেন, ‘সচেতন জনগণের সামনে এইসব তথ্যগুলো থাকুক। সময়ের পরিক্রমায় সত্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে তার আপন আলোয়’।