image

সরকার পতনের একদফা দাবিতে ঢাকাসহ সকল মহানগরে গণমিছিল করেছে বিএনপি। গণমিছিলে অংশ নিয়েছে হাজার হাজার নেতাকর্মী। বড় শোডাউনের মধ্যদিয়েই একদফার চতুর্থ কর্মসূচি পালন করেছে দলটির নেতাকর্মীরা। একই দাবিতে বিএনপি’র সঙ্গে ঢাকায়  

বিক্ষোভ মিছিল করেছে সমমনা দলগুলো। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল ঢাকায় পৃথকভাবে গণমিছিল করে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দুপুর থেকেই গুলশান ও দয়াগঞ্জ এলাকায় জড়ো হতে থাকেন হাজার হাজার নেতাকর্মী। পোস্টার, ফেস্টুন আর ব্যানারে ছেয়ে যায় পুরো এলাকা। সরকার বিরোধী স্লোগানে স্লোগানে বিকালে শেষ করেন কর্মসূচি। 

রাজধানীর দয়াগঞ্জে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি’র গণমিছিল পূর্ব সমাবেশে অংশ নেন বিএনপি’র শীর্ষ নেতারা। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ্য করে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকারের চতুর্দিকে রাস্তা বন্ধ, পালানোর পথ নেই। উত্তরে পর্বতমালা আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, কোনো দিকে যাওয়ার আর পথ নেই।

আর কোনো সময় নেই। মানে মানে এখনি পদত্যাগ করুন। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিন, সংসদ বিলুপ্ত করুন, নতুন নির্বাচন কমিশন করে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন। পদত্যাগ না করলে উত্তাল আন্দোলনের মধ্যদিয়ে জনগণ আপনাকে নিশ্চিহ্ন করে দিবে।

ভয়ে সরকারের মুখ শুকিয়ে গেছে মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিদেশিদের চাপের মুখে ভয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের মুখ শুকিয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এখন ভয়ে নানা আবল-তাবল বকছেন। আজকে শেখ হাসিনা সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের কথা বলছেন। কোন সংবিধান? যে সংবিধান কাটাছেঁড়া করে শেষ করা হয়েছে। ভয়ে তাদের মুখ শুকিয়ে গেছে। এখন আর টেলিভিশনে চকচকে মুখ দেখা যায় না। চকচকে কাপড় পরে সামনে আসে না। 

মির্জা ফখরুল বলেন, আমেরিকার ভিসা নীতির ভয়ে তারা (আওয়ামী লীগ) অনেক উল্টাপাল্টা কথা বলা শুরু করেছে। এখন ভারত মহাসাগর আর আরব সাগর বলে লাভ নাই। কোনো দিকেই পালানোর পথ নাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি করেছে। সেখানে বলেছে যে, যারা যারা এই অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছেন, যারা যারা সুষ্ঠু নির্বাচনে ভোট দিতে বাধা দেবে তাদের বিরুদ্ধে ভিসা নীতি প্রয়োগ করা হবে।


তিনি বলেন, ‘অবস্থা এখন আরও খারাপ। আমেরিকান মানুষেরা, বিভিন্ন সংস্থা, মানবাধিকার সংস্থার লোকেরা এখন তাদের সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বলতে শুরু করেছে যে, বাংলাদেশের ওপরে একটা শুনানি হোক। 

মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছি, আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশ র‌্যাব হামলা করছে। গ্রেপ্তার করেছে। আমাদের অনেক ভাই জীবন দিয়েছেন, তাদের রক্তকে আমরা বৃথা যেতে দেবো না। 

বিএনপি মহাসচিব বলেন, সরকার আজকে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করেছে যে, গোটা দেশটা একটা কারাগার। শত শত নেতাকর্মীকে কারাগারে আটক করে রেখেছে। আমাদের নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ, রবিউল ইসলাম রবি, রফিকুল আলম মজনু, মোনায়েম মুন্না, শাহিনসহ আরও অনেককে আটক করে রেখেছে। পুলিশকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের পুলিশ ভাইয়েরা কথায় কথায় রাত্রের অন্ধকারে আমাদের ছেলেদেরকে গ্রেপ্তার করেন, আপনাদের (পুলিশ) ৯ জন বড় বড় অফিসার তারা এখন আর আমেরিকা যেতে পারে না। তারা যে সহায়-সম্পদ তৈরি করেছিল বিদেশে, সেগুলোর কি হবে তার জন্য রাত্রে ঘুম হয় না তাদের। আমি খুব পরিষ্কার করে বলি, পুলিশের যারা কর্মকর্তা, যারা পুলিশের লোক তারা কখনোই অন্যায়-চুরি-চামারির সঙ্গে জড়িত না। জড়িত ওই বড়রা। তাদের সম্পূর্ণ বেআইনি নির্দেশে আজকে তারা পুলিশের রাজত্ব কায়েম করেছে তাই।’

‘পেনশন স্কীমের’ নামে সরকার নির্বাচনী ফান্ড তৈরির ফন্দি এঁটেছে বলে অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী লীগ লুট করে বাংলাদেশকে শেষ করে দিয়েছে, ফোকলা বানিয়ে দিয়েছে, কিচ্ছু নাই। আবার নতুন আরেকখান কায়দা বাইর করছে পেনশন স্কীম। মানুষের টাকা চুরি করার আরেকটা ফন্দি বাইর করছে। ওই টাকা চুরি করে ওরা নির্বাচন করতে চায়। মানুষ এবার তাদেরকে সেই সুযোগ দেবে না।

সরকারের উদ্দেশ্যে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমাদের পরিষ্কার কথা, ১৮ কোটি মানুষের দাবি যে, ভালোয় ভালোয় শান্তিপূর্ণভাবে বিদায় হন। অন্যথায় এদেশের মানুষ জানে স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী ডিক্টেটরকে কীভাবে সরাতে হয়। ৫২ সালে সরিয়েছে, ৬৯ সালে সরিয়েছে, ৭১ সালে সরিয়েছে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে, ‘৯০ সালে সরিয়েছে স্বৈরাচারকে, এবার আপনার পালা। তাই এখনো বলছি, সাবধান অবিলম্বে পদত্যাগ করুন, জনগণের দাবি মেনে নিন। অন্যায় জনগণ উত্তাল আন্দোলনের মধ্যদিয়ে তরঙ্গের পর তরঙ্গ তুলে সমুদ্রে যেমন টেউ আসে, সেই টেউ তুলে তুলে আপনাকে সুনামির মতো নিশ্চিহ্ন করে দেবে। 


গুলশান ১-এ উত্তরের গণমিছিলপূর্ব সমাবেশে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আজকে শুনলাম পাশের দেশের কিছু কর্মকর্তা নেপালে গেছে পানি পড়া আনতে। এই পানি পড়া দিয়ে কাজ হবে না। এই সরকারকে সরে যেতে হবে। তিনি বলেন, বিএনপি’র গণমিছিলে রাজপথ ভরে গেছে। লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। জায়গা নাই। এখন মিছিলের মাথা এবং পিছন এক হয়ে গেছে। আজকে দেশের সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে আমাদের গণমিছিলে যোগ দিয়েছে। কারণ এই সরকারকে দেশবাসী আর দেখতে চায় না। তিনি বলেন, গত ১৫ বছর লুটপাট এবং এই স্বৈরাচার সরকার আমাদের কাঁধে চেপে বসেছে। ধাক্কা দিলেও পড়ে না। তাই এখন টেনে-হিঁচড়ে এখান থেকে নামাতে হবে। আর আজকে ১৫ বছর ধরে আপনারা (বিএনপির নেতাকর্মীরা) আন্দোলন করছেন। এ সময়ে কয়েক পুরুষ পরিবর্তন হয়ে গেছে। কিন্তু এই অবৈধ সরকার পরিবর্তন হলো না! কারণ এই সরকার অবৈধভাবে এবং বিভিন্ন কায়দায় ক্ষমতায় আছে। কখনো জনগণের ভোটে এই সরকার ক্ষমতায় আসে নাই। সরকারের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, হত্যা, গুম এবং হুমকি ১৫ বছর দিয়েছেন। এটাকে আর কেউ ভয় পায় না। আপনাদের সকল অস্ত্র ভোঁতা হয়ে গেছে। এই অস্ত্র আর কাজ করবে না। 

ঢাকার গণমিছিলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, একটি কথাই বলা যায়, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। তার অধীনে আমরা কোনো নির্বাচনে যাবো না। আমাদের অধিকার গণতান্ত্রিক অধিকার আমাদের উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ভারত যদি আবার ১৪ সালের মতো শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে চায় চ্যালেঞ্জ এদেশের ১৮ কোটি জনগণ এবার ছাড়বে না।

বিএনপি’র আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান বলেন, জনগণ সরকারকে লাল কার্ড দেখিয়ে দিয়েছে। দেশের ১২ কোটি ভোটার আজ রাজপথে নেমেছে। লাল পতাকা দেখানো হলে মাঠ ছেড়ে চলে যেতে হয়। দেশের মানুষ এই সরকারে প্রতি অনাস্থা দিয়েছে, সেটাই হচ্ছে আজ গুরুত্বপূর্ণ। কেন না সংসদের ভেতরে যাদের অনাস্থা দেবার কথা, তারা বিনা ভোটের এমপি। কাজেই তাদের মতামতের কোনো মূল্য নেই যা দিয়ে এদেশে তারা জন প্রতিনিধিত্বকারী কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারে। নজরুল ইসলাম খান বলেন, বিনা ভোটে জোর করে ক্ষমতায় আছে এই সরকার। অত্যাচার ও নির্যাতন করে দেশ শাসন করছে। এই সরকারের আমলে মানুষ নির্যাতিত। তাই দেশের সব বিরোধী দল সরকার পতনে একদফা আন্দোলন শুরু করেছে। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নয় বলেই জনগণের শক্তিকে মূল্যায়ন করছে না। তাই আন্দোলনকে আরও শাণিত করতে হবে এবং সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে হবে। স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ সকালে মার্কিনিদের গালি দেয়, বিকালে আবার ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়। যারা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পক্ষে তারাই আমাদের বন্ধু।

এদিকে পূর্বঘোষিত কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে জুমার নামাজের পর দয়াগঞ্জে নেতাকর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে জড়ো হন। বিকাল ৪টায় দয়াগঞ্জ থেকে গণমিছিল শুরু করে ঢাকামহানগর দক্ষিণ বিএনপি। এতে অংশ নেন বিএনপি’র শীর্ষনেতাসহ বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। দয়াগঞ্জ মোড় ও আশপাশে নেতাকর্মীর ঢল নামে। খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সরকারের পদত্যাগের দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে এলাকা। পরে গণমিছিলটি সায়েদাবাদ, মানিকনগর, কমলাপুর স্টেডিয়ামের সড়ক দিয়ে খিলগাঁও চৌরাস্তায় গিয়ে শেষ হয়। একই সময়ে মহানগর উত্তরের উদ্যোগে রাজধানীর গুলশান-১ থেকে ওয়ারলেস, তিতুমীর কলেজ সড়ক দিয়ে মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে শেষ হয়। ঢাকা উত্তরের গণমিছিলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, কেন্দ্রীয় নেতা আবুল খায়ের ভূঁইয়া, কামরুল ইসলাম, আতাউর রহমান ঢালী, মজিবুর রহমান সারোয়ার, রশিদুজ্জামান মিল্লাত, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, নাজিমউদ্দিন আলম, এবিএম মোশাররফ হোসেন, তাবিথ আউয়াল, আামিনুল হক প্রমুখ নেতারা অংশ নেন। গণমিছিলে বিশাল শোডাউন করে ছাত্রদল ঢাকা মহানগর উত্তরের নেতাকর্মীরা। এদিকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালামের সভাপতিত্বে ও ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিনের সঞ্চালনায় সংক্ষিপ্ত সমাবেশে দলের শীর্ষ নেতারা বক্তব্য দেন। পরে গণমিছিলে যোগ দেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আবদুস সালাম। এ ছাড়া ছাড়াও জয়নুল আবেদীন, মনিরুল হক চৌধুরী, জয়নাল আবেদীন ভিপি জয়নাল, আসাদুজ্জামান রিপন, ফজলুল হক মিলন, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, কামরুজ্জামান রতন, শিরিন সুলতানা, নাসির উদ্দিন অসীম, আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, রাকিবুল ইসলাম বকুল, যুবদলের সুলতান সালাউদ্দিন টুকুসহ কেন্দ্রীয় ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।