image

চলমান আন্দোলনে জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য আগামীকাল ২ আগস্ট, ২০২৩ তারিখে একটি মামলার রায় ঘোষণা হতে যাচ্ছে। মামলার গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করলেই বুঝতে পারবেন যে, এটি একটি ফরমায়াসি রায়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনোদিত দুদকের মামলায় বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান ও তাঁর সহধর্মিনী ডাক্তার জুবাইদা রহমান হচ্ছেন সরকারের এই প্রতিহিংসামূলক মামলার শিকার।

এই মামলার ঘটনা এগিয়েছে একেবারে সুপারসনিক গতিতে! বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কোনো মামলা এতো দ্রুত নিষ্পত্তি করে রায় দেয়ার কোনো নজীর নেই। ২০২২ সালের ১ নভেম্বর জাজ কোর্টে মামলার চার্জ উপস্থাপন করে যথাক্রমে ২০২৩ সালের ১৯ জানুয়ারি, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২৯ মার্চ, ৯ এপ্রিল এবং ১৩ এপ্রিলের মধ্যে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ৫টি তারিখ ফেলে চার্জ শুনানি, চার্জ আপত্তি ও চার্জ গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

এখানেই শেষ নয়; মামলার ট্রায়াল শুরু হয় ২০২৩ সালের ১৬ মে। সাধারণত মামলার শুনানির তারিখগুলো কমপক্ষে এক মাসের ব্যবধানে রাখা হলেও এই মামলায় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী আচরণ করে কখনো কখনো তিন দিনের ব্যবধানেও শুনানি করা হয়েছে। ট্রায়ালের তারিখগুলো ছিল যথাক্রমে- ১৬ মে, ২১ মে, ১১ জুন, ১৬ জুলাই, ২০ জুলাই, ২৪ জুলাই এবং ২৭ জুলাই।

মাত্র এই সাত দিনের শুনানিতে এই মামলার বিচারক মোট ৪২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন! যা বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা! এখানেই শেষ নয়, ওই বিচারক বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের জারি করা ‘সিভিল রুলস এন্ড অর্ডারস অফ দা সুপ্রিম কোর্ট অফ বাংলাদেশ হাইকোর্ট ডিভিশন’ অমান্য ও অগ্রাহ্য করে আদালত পরিচালনার সুনির্দিষ্ট সময়সীমার বাইরে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন। এমনকি আদালতের সময় অতিক্রম করে রাত হয়ে যাওয়ার কারণে বাদী পক্ষের আইনজীবী যখন বিচারককে অনুরোধ করেছেন শুনানি স্থগিত করে পরের তারিখ দিতে, তখন বিচারক বাদী পক্ষের আইনজীবীকে ভৎসনা করে নিজের স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তে আদালত পরিচালনা করে গিয়েছেন। কোন সাক্ষী যখন জনাব তারেক রহমান কিংবা ডাঃ জুবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ভাবে সাক্ষ্য দিতে রাজি হন নাই, তখন তাদেরকে তিনি ভয়-ভীতি দেখিয়েছেন এবং একান্তে ডেকে নিয়ে জনাব তারেক রহমান এবং ডাঃ জুবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছেন। বিষয়টির প্রতক্ষ্য সাক্ষী আদালতে উপস্থিত বাদী ও বিবাদী পক্ষের আইনজীবীরা।

যে মামলার শুনানি শেষ হলো মাত্র ২৭ জুলাই, সেই মামলার রায়ের তারিখ ধার্য করা হয়েছে ২ আগস্ট। এতো দ্রুত একটি মামলার রায় লেখা কারো পক্ষে সম্ভব নয়; স্বয়ং সুপারম্যানের পক্ষেও না। সুতরাং যুক্তি সঙ্গত প্রশ্ন হচ্ছে- তাহলে কি মামলার রায় আগে থেকেই লিখে রাখা হয়েছে। দুই দিনের ছুটি নিয়ে ওই বিচারক কি সেই রায় কপি-পেস্ট করে আগামীকাল আদালতে পাঠ করবেন? অবস্থা দৃষ্টি সেটাই হবে বলে মনে হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে- জনাব তারেক রহমান এবং ডাঃ জুবাইদা রহমানকে শাস্তি দেওয়ার জন্যই এই বিচারককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল এবং হয়তো ভবিষ্যৎ পদোন্নতির লোভেই তিনি এই বিচারবহির্ভূত আচরণের মাধ্যমে একটি ফরমায়েসি রায় দিতে যাচ্ছেন!

এই সরকারের আমলে সংগঠিত সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড সাগর-রুনির হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় পিছিয়েছে মোট ৯৮ বার, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে জালিয়াতি করে সুইফট কোডের মাধ্যমে অর্থ চুরির মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পিছিয়েছে মোট ৭২ বার। বছরের পর বছর পার হয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পেছানোর সংখ্যা সেঞ্চুরির কাছাকাছি পৌঁছে গেলেও দেশের মানুষ জানে না কবে এই মামলা গুলোর বিচার শুরু হবে। অথচ সেই একই বিচার বিভাগ কর্তৃক শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য একটি মামলা কে এত দ্রুত নিষ্পত্তি করে রায় দিতে হচ্ছে! রাজনৈতিক সরকার না হয় দেউলিয়া হয়ে গেছে কিন্তু বিচার বিভাগও কি দেউলিয়া হয়ে গেল!

উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের বেসামরিক লেবাসের সামরিক সরকার বিএনপি’র তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে কোন সুনির্দিষ্ট মামলায় গ্রেপ্তার করতে না পেরে বিতর্কিত বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৫৪ ধারায় আটক করে। এরপর তড়িঘড়ি করে ওরা তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা সাজায়। উনি যখন ৫৪ ধারায় আটক, তখন তাকে তাঁর সম্পদের বিবরণী দিতে বলা হয়। বিষয়টা অনেকটা হাত-পা বেঁধে কাউকে সাঁতার কাটতে বলার মত কাজ।

জনাব তারেক রহমান ১৯৮২ সাল থেকে শুরু করে ২০০৬ সাল পর্যন্ত উনার সম্পদের বিবরণী প্রদান করেন। সেই সম্পদের বিবরণীর একটি অংশে দুদক আপত্তি প্রদান করে সেটার ভিত্তিতে ঢাকার কাফরুল থানায় ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ৫২(৯)০৭ নং মামলা দায়ের করে বলা হয় ডাঃ জুবাইদা রহমানের নামে থাকা ৩৫ লক্ষ টাকার এফডিআর উনি স্বামী তারেক রহমানের টাকায় করেছেন।

সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ ছিল, এই এফডিআরের টাকা ডাঃ জুবাইদা রহমানের মাতা বিশিষ্ট সমাজসেবিকা সৈয়দা ইকবাল মান বানু তাদের সম্পত্তি ও বাড়ি ভাড়ার আয় থেকে মেয়েকে প্রদান করেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ডাঃ জুবাইদা রহমানের কোন ভাই নেই এবং উনারা দুই বোন। সুতরাং উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের বিপুল সম্পত্তি থেকে যে আয় হয়, তার একটি অংশ উনার প্রাপ্য এবং সেই টাকা দিয়েই ডাঃ জুবাইদা রহমানের নামে এফডিআর করা হয়েছিল।

কিন্তু দুদক এই মর্মে মামলা করে যে, এই এফডিআরের টাকা জনাব তারেক রহমানের কাছ থেকে ডাঃ জুবাইদা রহমান নিয়ে এফডিআর করেছেন আর তাতে সহযোগিতা করেছেন তার মাতা সৈয়দা ইকবাল মান বানু!

কী হাস্যকর! মাত্র ৩৫ লক্ষ টাকা এফডিআর-এর মামলায় আসামী তারেক রহমান, তাঁর সহধর্মিণী ডাঃ জুবাইদা রহমান এবং তাঁর শাশুড়ি! যেখানে ছাত্রলীগের জেলা পর্যায়ের নেতা হাজার কোটি টাকা পাচার করে দেয়, সেখানে পৈত্রিক সম্পত্তির আয় থেকে পাওয়া মাত্র ৩৫ লক্ষ টাকার জন্য মামলা! এই সেই কুখ্যাত মামলা, যে মামলাতে শোন এরেস্ট দেখিয়ে জনাব তারেক রহমানকে ২০০৭ সালের ৭ ডিসেম্বর রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক আঘাত ও নির্যাতন করা হয়েছিল।

যাইহোক, বহুল সমালোচিত এই মামলাটির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা হয়েছিল এবং ২০০৮ সালের ৩১ জানুয়ারি হাইকোর্টের আদেশে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি ডাঃ জুবাইদা রহমানের মাতা সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর আইনজীবীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের আদেশে মামলা থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। উনার অব্যাহতি পাওয়ার মাধ্যমে এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, মামলাটি ছিল সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বানোয়াট এবং ষড়যন্ত্রমূলক।

সবচেয়ে বড় কথা- কোন সম্পদ যদি হিসাব বিবরণীতে কোন তথ্য ভুলক্রমে দেখানো না হয়, তাহলে সেটা আয়কর আইনের আওতায় আসবে, কোনভাবেই দুদকের আইনের আওতায় না।

কিন্তু সরকার থেমে থাকেনি। ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল হাইকোর্টের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং কৃষ্ণা দেবনাথ-এর কুখ্যাত বেঞ্চ এই মামলাটির স্থগিতাদেশ বাতিল করে ডাঃ জুবাইদা রহমানকে সাত সপ্তাহের মধ্যে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেয়। এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল হয়; অবশেষে ২০২২ সালের ১৩ এপ্রিল আপিলেট ডিভিশনেও মামলাটির স্থগিতাদেশ বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল রেখেই আদেশ দেয়া হয়। তারপর এত দ্রুত গতিতে মামলা নিষ্পত্তির মূল কারণ যে কেবলই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, তা নিশ্চই বলার অপেক্ষা রাখে না।

আমাদের স্মরণে আছে কিভাবে একটি মিথ্যা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ফরমায়েসি সাজা দেয়ার পুরস্কার হিসেবে একজন পদলেহী বিচারককে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়েছিল। গোপালগঞ্জের আসাদুজ্জামান সাহেবও হয়তো সেই একই পথে হাঁটছেন। ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তির লোভে আসাদুজ্জামান এটা ভুলে গিয়েছেন যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই ধরনের ফরমায়াসি রায় দেবার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে মার্কিন ভিসা স্যাংশনের খড়গ নেমে আসবে এবং সেটা থেকে আওয়ামী লীগের আইনজীবী নেতা সালাম-কাজলরাও রেহাই পাবেন না।

কিন্তু এতকিছু করেও কি আসাদুজ্জামান-সালাম-কাজল কিংবা এই ফ্যাসিস্ট সরকার কি জনাব তারেক রহমান এবং ডাঃ জুবাইদা রহমানের ইমেজের কোন ক্ষতি করতে পারবে?

ক্রিকেটের মাঠে যে ব্যাটসম্যান ইতোমধ্যে সেঞ্চুরি করে ফেলেছে তাকে পিটিয়ে পরাজিত করা যায় না বা তার সেঞ্চুরির ইতিহাস রেকর্ড বুক থেকে মুছে দেয়া যায় না; তাকে পরাজিত করতে হলে তার চেয়ে বেশি রান করতে হয়। একাডেমিক এবং মানবিক কর্মকাণ্ডে ডাঃ জুবাইদা রহমান যে সকল মাইল ফলক সৃষ্টি করেছেন, এসব ফরমায়েসী মামলার রায় দিয়ে তাঁর কোনটি মুছে দেওয়া সম্ভব নয়। এসব মামলার রায়ের পরেও তারেক রহমান এবং ডাঃ জুবাইদা রহমান নিজের কীর্তিতে আলোকিত হয়ে থাকবেন, তাঁদের পূর্বপুরুষদের মতই, যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী।